পন্য বয়কট ও অবরোধ!

বিভিন্ন দেশের পন্য বয়কট করার পাশাপাশি আমরা আজ নিজ দেশের পন্য বয়কট করছি!? অন্য দেশের জালেমরা যেমন আমাদের মা, বোন, শিশুদের উপর হত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে, অপরিদকে এই দেশের অসাধু ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের চক্র মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে।

আসলে সারাবিশ্বে জালেমদের চরিত্র একই! নিজেদের দুনিয়ার লালসার জন্য অন্যদের মৌলিক অধিকারেরর উপর আঘাত হানে।

হাস্যকার হলেও চরম সত্যি অনেকে আজও বয়কটের পক্ষে/বিপক্ষে দলিল দেয়। হ্যা আমরা ইচ্ছে করলে সাথে সাথে ডলারনীতি, চায়ানাপন্য বয়কট করতে পারছি না। বা যারা প্রবাসে আছে তাদের জন্য বয়কট করা এতটা সহজ নয়! কিন্তু যারা বয়কট অব্যাহত রেখেছে তাদের আন্দোলন সম্মান ও সমর্থন জানানো উচিত!

যারা এর বিরোধিতা করে তাদের জানাই- আপনারা চাইলে সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সুদের ধোয়া হতে মুক্ত থাকতে পারবেন না, তার মানে কি সুদ খাওয়া উচিত মনে করবেন নাকি সুদ বর্জন করে নিজেকে গোনাহ হতে রক্ষা করবেন। কারন অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনের ক্ষমতা না থাকলেও সরাসরি সুদ গ্রহন হতে নিজেকে বিরত রেখে জাহান্নাম হতে বাচাতে পারেন।

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ লোকেদের মধ্যে এমন যুগ আসবে যখন একজন মানুষও সুদের ব্যবহার থেকে মুক্ত হতে পারবে না। সে প্রত্যক্ষভাবে সুদ না খেলেও সুদের ধোয়া বা ধূলা তাকে সংস্পর্শ করবে। (আহমাদ, আবূ দাঊদ, নাসায়ী)

হাদীসটা যঈফ হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে মিলে! তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে! জালেমদের পরিকল্পনা হতে- ভারতে যখন চীনের পন্য বয়কটের আন্দোলন হচ্ছিল ভারতীয়রা Boycott China টিশার্ট পড়ছিল তা তৈরি হয়েছিল চীনেই। মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা অর্থ হাতিয়েছে।

তেমনি হয়তো বিদেশী পন্যগুলো নতুনরূপে আসতে পারে! আবার এসব পন্য বয়কটের সুবাদে কাদেয়ানী, মুনাফেকদের পন্যগুলোর দিকে আমরা যেন ছুটে না যাই। ইসলামের শত্রুকে শক্তিশালী করা মানে – মুসলিমদের দুর্বল করা ও আঘাত প্রদানে সহযোগিতা করা।

তাই বয়কট আন্দোলন পরিধি বাড়ানো প্রয়োজন। উচ্চদরের পন্যের পাশাপাশি, যারা আল্লাহ বিরোধী আইন তৈরি ও পরিচালনা করে, ইসলাম মানা ও প্রচারের কারনে নির্যাতন করে – মুসলিম ও আলেমদের সামর্থ্য থাকলে তাদেরকেও বয়কট করা উচিত। আবার অনেকে ঈমানের দুর্বলতা বা প্রতিকূলতার কারনে কেউ করতে না পারলে তাকে তাকফীর না করি, দাওয়াহ দিই।

মুসলিমদের বয়কট যেমন উপকারী সমর্থনযোগ্য তেমনি মুজাহিদদের অবরোধকে সমর্থন দেওয়া উচিত! এর বিরোধিতা ঈমানের জন্য সাংঘর্ষিক।

ছুমামাহ্ ইবনুল উছালের (রা) ইসলাম গ্রহণের ঘটনা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদল অশ্বারোহী নজদ অভিমুখে প্রেরণ করলেন। তাঁরা ইয়ামামাবাসীদের সরদার ছুমামাহ বিন উছালকে (রা) বন্দি করে আনলেন।

তিন দিন পর্যন্ত মসজিদের এক খুঁটির সাথে তাকে বেঁধে রাখা হল।

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই তার পাশ দিয়ে যেতেন তাকে জিজ্ঞাসা করতেন, ছুমামাহ! তোমার কী ধারণা- আমি তোমার সাথে কেমন আচরণ করব? জবাবে তিনি বলতেন, মুহাম্মাদ! আমি আপনার কাছে উত্তম আচরণেরই প্রত্যাশা করি। আপনি যদি আমাকে হত্যা করেন, একজন হত্যাযোগ্য ব্যক্তিকেই হত্যা করবেন।

আর আমার উপর অনুগ্রহ করলে একজন কৃতজ্ঞ ব্যক্তির উপর অনুগ্রহ করা হবে। আর আপনার যদি সম্পদের কামনা থাকে, খুলে বলুন, আপনি যা চাইবেন তাই আপনাকে দেয়া হবে। এভাবে একাধিকবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার মাঝে কথোপকথন হল।

একপর্যায়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যখন মনে হল, তাকে মুক্ত করে দেয়াই ভালো। তাকে মুক্ত করে দিলেন। আল্লাহ পাক ছুমামাহর অন্তরে ঈমানের নূর ঢেলে দিলেন।

ছাড়া পেয়ে তিনি ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তাকে ইসতেকবাল করে নিকটবর্তী একটি কূপের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। তিনি গোসল করে পবিত্র হলেন এবং কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলেন। এরপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বললেন, হে মুহাম্মাদ! ইতিপূর্বে আমার কাছে আপনার চেহারাই ছিল সবচে’ অপ্রিয়। আর আজ আমার নিকট আপনার চেহারাই সবচে’ প্রিয়। পূর্বে আমার কাছে আপনার শহর ছিল সবচে’ অপছন্দনীয় আর আজ আমার নিকট আপনার শহরই সবচে’ পছন্দনীয়। পূর্বে আমার নিকট আপনার ধর্ম ছিল সবচে’ ঘৃণিত আর আজ আপনার ধর্মই আমার সবচে’ কাক্সিক্ষত ধর্ম।

অতপর হযরত ছুমামাহ রাযিআল্লাহু আনহু নবীজীকে সম্বোধন করে বললেন, আল্লাহর রাসূল! আপনার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক, আমি মুশরিক থাকা অবস্থায় উমরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেছিলাম, পথিমধ্যে আপনার অশ্বারোহী মুজাহিদ বাহিনী আমাকে বন্দি করে আনে। সুতরাং আমার উমরাটা পুরা করার সুযোগ করে দিন। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে উমরার বিধান শিক্ষা দিলেন এবং উমরা আদায়ের ব্যবস্থা করে দিলেন।

হযরত ছুমামাহ রাযিআল্লাহু আনহু উমরার উদ্দেশ্যে যখন মক্কায় পৌঁছলেন এবং কুরাইশরা শুনল যে, তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম নিয়ে কথা বলছেন তখন তারা তাঁকে উত্ত্যক্ত করতে লাগল এবং বলতে লাগল ছুমামাহ কাফের হয়ে গেছে। জবাবে তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ, আমি কাফের হয়নি; বরং মুসলমান হয়েছি। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশ্বাস করেছি। তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি।

সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, ইয়ামামা থেকে একটি শস্যদানাও তোমাদের কাছে আসবে না। কেবল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিলেই আমি তোমাদেরকে শস্য দিব।

হযরত ছুমামাহ রাযিআল্লাহু আনহু নিজ শহরে ফিরে গেলেন এবং মক্কায় শস্য রফতানি বন্ধ করে দিলেন। মক্কার সকল খাদ্যশস্যের যোগান হত ইয়ামামা থেকে। ফলে কুরাইশরা দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হল। তখন তারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চিঠি লিখল। তারা নবীজীর সাথে তাদের আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে বলল, নিশ্চয় আপনি আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখার আদেশ করেন। আমরা আপনার আত্মীয়।

ছুমামাহ খাদ্যশস্য রফতানি বন্ধ করে দিয়ে আমাদেরকে এবং আমাদের নারী-শিশুদেরকে মৃত্যুমুখে পতিত করেছে। আপনি আমাদের রক্ষা করুন এবং ছুমামাহকে চিঠি লিখুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুমামাহ্কে চিঠি লিখলেন, তিনি যেন আল্লাহর হেরেমের এই বয়কট এবং খাদ্যশস্য রফতানি জারি করে হেরেমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। হযরত ছুমামাহ রাযিআল্লাহু আনহু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশে কুরাইশদের উপর থেকে অবরোধ উঠিয়ে নিলেন।

[দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৩৭২ (সংক্ষিপ্ত , ; সহীহ মুসলিম ৪৪৮১ , হাদীস,সুনানে আবুদাউদ,ইবনে হিশাম)

রসুল (সা:) এর উত্তম আচরনের কারনে ছুমামা (রা:) ঈমান আনে। তাই মুশরিক, জালেমদের উত্তম আচরনের সাথে দাওয়াত দেওয়া যেতে পারে। গ্রহন না করে উল্টো কোরাইশ মুশরিকদের মত আঘাত করতে চাইলে আমাদের ও কঠোর হতে হবে।

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইসলামের ব্যাপারে মক্কার কাফেরদের বিদ্বেষ দেখে হযরত ছুমামাহ রা.-এর ঈমানী চেতনা জেগে উঠে। তিনি তাঁর ক্ষমতা ও সম্পদ ইসলামের স্বার্থে কাজে লাগালেন। মক্কার কাফেরদের জানিয়ে দিয়েছিলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতি ব্যতীত একটি শস্যদানাও ইয়ামামা থেকে মক্কায় আসবে না এবং অবরোধ করেছিলেন।

তাই ইসলামের শত্রুদের ইসলাম ও মুসলিমের উপর আঘাত, নির্যাতন, জুলুমে কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া ঈমানী চেতনার পরিচয়। একে ভিন্ন নামে সম্বোধন করা উচিত নয়। রসুল (সা:) ছুমামা (রা:) কে অবরোধের জন্য নিন্দা করেননি। অবরোধ উঠানোর অন্যতম কারন ছিল- মক্কার হেরেমের সম্মান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *