সাহাবী, তাবেয়ী এবং তার পরবর্তী বহু যুগ এমন ছিল সহীহ হাদীস পেলে মুমিনরা যুক্তি-তর্কের উর্ধ্বে গিয়ে মেনে নিত। বর্তমানে যে কোন কিছুকে অনেকে যুক্তি ও ইতিহাস বা নিজেদের প্রিয় আলেমের ব্যাখার সাথে মিললে গ্রহণ করবে নাহলে পরিত্যাগ করবে এমনটাই পরিলক্ষিত হয়।
আবদুল্লাহ ইবনু মাসলামা ইবনু কানাব, কুতায়বা ইবনু সাঈদ, যুহায়র ইবনু হারব ও আমর আন নাকিদ (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “জনগণ এর বিষয়ে (প্রশাসনিক ব্যাপারে) কুরায়শদের অনুসারী। মুসলিমরা তাদের মুসলিমদের এবং কাফেররা তাঁদের কাফেরদের (অনুসারী)। (মুসলিম)
মুহাম্মাদ ইবনু রাফি’ (রহঃ) … হাম্মাম ইবনু মুনাব্বিহ (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে যে সকল হাদীস রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আমাদের কাছে বর্ণনা করেন তন্মধ্যে একটি হল যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ লোকজন এই ব্যাপারে কোরায়শের অনুসারী মুসলিমরা মুসলিমদের অনুসারী এবং কাফেররা কাফেরদের অনুসারী। (মুসলিম)
ইয়াহইয়া ইবনু হাবীব হারেসী (রহঃ) … জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ লোকজন ভাল-মন্দ (উভয় ব্যাপারেই) কুরায়শের অনুসারী।
আহমাদ ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু ইউনুস (রহঃ) … আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এ কর্তৃত্ব (খেলাফত)
সর্বদা কুরায়শের মধ্যেই থাকবে যতক্ষন পর্যন্ত (দুনিয়ার) দুটি লোকও বেঁচে থাকবে। (মুসলিম)
কুতায়বা ইবনু সাঈদ ও রিফা’আ ইবনু হায়সাম ওয়াসেতী (রহঃ) … সামুরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমি আমার পিতার সঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট গেলাম। তখন আমরা তাঁকে বলতে শুনলাম, শাসন ক্ষমতার ব্যাপারটা চলতে থাকবে যতক্ষন না উম্মাতের মধ্যে বারজন খলীফা অতিবাহিত হবেন। তারপর তিনি কিছু বললেন, যা আমার কাছে অস্পষ্ট ছিল। তখন আমি আমার-পিতাকে জিজ্ঞাসা করলাম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বললেন? তিনি বললেন যে, তিনি বলেছেন, তাদের সকলেই হবে কুরায়শ বংশোদ্ভূত। (মুসলিম)
সবগুলো হাদীস মুসলিম শরীফে রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রশাসন অধ্যায়ে পাবেন।
রসুলের (সা:) ওফাতের পর খলিফা নির্বাচন নিয়ে সাহাবীরা জড়ো হলে- আবু বকর (রা:) বলেছিলেন, তবে খিলাফাতের ব্যাপারটি কেবল এই কুরাইশ বংশের জন্য নির্দিষ্ট। তারা হচ্ছে বংশ ও আবাসভূমির দিক দিয়ে সর্বোত্তম আরব। আর আমি এ দু’জন হতে যে কোন একজনকে তোমাদের জন্য নির্ধারিত করলাম। তোমরা যে কোন একজনের হাতে ইচ্ছা বায়’আত করে নাও। (সহীহ বুখারী, বায়াত ও বংশীয় শাসন পোস্টে পুরাটা পাবেন)।
সাফীনাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ নবুওয়্যাতের ভিত্তিতে পরিচালিত খিলাফত ত্রিশ বছর অব্যাহত থাকবে। অতঃপর আল্লাহর যাকে ইচ্ছা রাজত্ব বা তাঁর রাজত্ব দান করবেন। সাঈদ (রহঃ) বলেন, আমাকে সাফীনাহ (রাঃ) বলেছেন, হিসেব করো, আবূ বকর (রাঃ) দুই বছর, ‘উমার (রাঃ) দশ বছর, ‘উসমান (রাঃ) বারো বছর ও আলী (রাঃ) এতো বছর খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেছেন। সাঈদ (রহঃ) বলেন, আমি সাফীনাহ (রাঃ) -কে বললাম, এরা ধারণা করে যে, ‘আলী (রাঃ) খলীফাহ ছিলেন না। তিনি বলেন, বনী যারকা অর্থাৎ মাওয়ানের বংশধরগণ মিথ্যা বলেছে।
সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৬৪৬
হাদিসের মান: হাসান সহিহ
অনেকে হাসান (রা:) এর ছয় মাস পর্যন্ত খেলাফতের সময়কাল ধরেন। আর ১২ জন ন্যায়পরায়ন খলিফার মধ্যে ৫ জন হাসান (রা:) পর্যন্ত। উমর বিন আবদুল আজিজ (রহ:) এবং শেষ খলিফা মাহাদী (হাফি:) হবেন আলেমরা ঐক্যমত।
এছাড়া আর কিছু হাদীসে কোরাইশ হতে খলিফা হবে প্রমাণ পাওয়া যায়। একথা বললে অনেকে ইহুদিদের দালাল, আহলে খবিশ, রাজতন্ত্রের সমর্থনকারী আবার অনেকে এটা হিন্দুদের জাতপ্রথার মতো হয়ে গেছে বলে অভিহিত করে।
আল্লাহর কসম!! আমাদের উদ্দেশ্য সত্য জানানো! ফেতনা ছড়ানো বা অর্থ উপার্জন, জনপ্রিয়তা অর্জন নয়। বরং আমরা এমন কিছু জানাতে চাই যা অন্যরা সাধারণত বলে না। ফলে উপহাস, গালির শিকার হতে হচ্ছে!! আপনাদের সাথে মতে না মিললে হয়তো আমাদের বুঝিয়ে দেন, মেনে নিবো। আর আমাদের গালি দিলে, আপনাদের নেকী হবে এমন কোন দলিল যদি থাকে হাসিমুখে মেনে নিবো।
এবার আসি ব্যাখা-
আল্লাহ সকল সৃষ্টির উপর মানবজাতিকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এটা আল্লাহর সিদ্ধান্ত, বান্দা মেনে নেওয়া উচিত। ইবলিস আদম (আ:) সহ মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করে ধ্বংসপ্রাপ্তের অন্তর্ভুক্ত হয়।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা হলেন আল-আলীম (সর্বজ্ঞ)। তিনি জানেন কি এবং কি হতে পারে, কি ছিল এবং কি হতে পারে। “এর পরিপূর্ণতা জ্ঞান দ্বারা সবকিছু বোঝার মধ্যে নিহিত – প্রকাশ এবং গোপন, ছোট এবং বড়, প্রথম এবং শেষ, শুরু এবং ফলাফল।”
আমরা আমাদের চারপাশে যা দেখি এবং অভিজ্ঞতা করি তার দ্বারা অবশ্যই আমাদের জ্ঞান অর্জন করি। অন্যদিকে, আল্লাহর জ্ঞানের কোন শুরু বা শেষ নেই এবং এটি পরীক্ষা ও ত্রুটির উপর ভিত্তি করে নয়।
আল্লাহর জ্ঞান পরিপূর্ণ ও নিখুঁত। এটি অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে বোঝায় এবং সর্বদা বাস্তবতার সাথে মিলে যায়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ
“তিনি কি জানেন না যে তিনি কি সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি সূক্ষ্ম, অবহিত।”
আল-মুলক ৬৭:১৪
সূরা আল-আনআম আয়াত ৫৯-এ তিনি বলেন,
“এবং তাঁর কাছেই রয়েছে অদৃশ্যের চাবি; তিনি ছাড়া তাদের কেউ জানে না। আর তিনি জানেন স্থলে ও সমুদ্রে যা আছে। একটি পাতাও পড়ে না কিন্তু তিনি তা জানেন।”
সূরা আল আনআম, ৫৯
আল্লাহ জানতেন মুমিনরা তার আমল দ্বারা আল্লাহর কাছে অতি প্রিয় হবে ও সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করবে যা ফেরেশতারা জানতো না। তাই আল্লাহ মুমিনদের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ঘোষণা করেন। তেমনি আল্লাহ জানতেন – কোরাইশরা নেতৃত্ব দানে সবচেয়ে উপযোগী হবে বা শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের কোরাইশ হতে তিনি পাঠাবেন বা নেতৃত্বের উপযোগী করবেন। তাই কোরাইশদের নেতৃত্ব দানের নির্দেশ দিয়েছেন। আবার এটা ইব্রাহিম (আঃ) এর দোয়ার ফসল।
কুরআনে বর্নিত –
‘যখন ইবরাহীমকে তার পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তাতে উত্তীর্ণ হ’লেন, তখন আল্লাহ বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করব। তিনি বললেন, আমার বংশধর থেকেও। তিনি বললেন, আমার অঙ্গীকার যালেমদের পর্যন্ত পৌঁছবে না’
বাক্বারাহ ২/১২৪
বস্ত্ততঃ আল্লাহ ইবরাহীম (আ) ও তাঁর বংশধরগণের মধ্যেই বিশ্ব নেতৃত্ব সীমিত রেখেছেন। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম, নূহ, ইবরাহীম-এর বংশধর ও ইমরানের বংশধরকে নির্বাচিত করেছেন’। ‘যারা ছিল পরস্পরের বংশজাত। আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’
আলে ইমরান ৩/৩৩, ৩৪
বস্তুত ইবরাহীম (আঃ)-এর পরবর্তী সকল নবী তাঁর বংশধর ছিলেন। আলে ইমরান বলতে ইমরান-পুত্র মূসা ও হারূণ ও তাঁদের বংশধর দাঊদ, সুলায়মান, ঈসা (আ) প্রমুখ নবীগণকে বুঝানো হয়েছে। যাঁরা সবাই ছিলেন ইবরাহীমের (আ) পুত্র ইসহাকের (আ) বংশধর। অপরপক্ষে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (সা) ছিলেন ইবরাহীমের (আ) জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈলের (আ) বংশধর। সে হিসাবে আল্লাহ ঘোষিত ইবরাহীমের (আ) বিশ্ব নেতৃত্ব যেমন বহাল রয়েছে, তেমনি নবীদের প্রতি অবাধ্যতা, বংশীয় অহংকার এবং জেদ ও হঠকারিতার জন্য যালেম ইহুদী-নাছারাগণ আল্লাহর অভিশাপ কুড়িয়ে বিশ্বের সর্বত্র ধিকৃত ও লাঞ্ছিত হয়েছে।
ইব্রাহিমের (আঃ) দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। অধিকাংশ নবী, রসুলগণ ইব্রাহিম (আঃ) এর পুত্র ইসহাকের (আ) বংশধর ও তার বংশধর ইয়াকুব (আ:) হতে এসেছিল বা আল্লাহ পাঠিয়েছিলেন।
ইয়াকুব (আ:) এর উপাধি ছিল ইসরায়েল মানে আল্লাহর বান্দা আর তার বংশধরদের বনী ইসরায়েল বলা হতো।
আলেমদের মতে, তার এক ছেলে ইয়াহুদের নামে একটা মতবাদ চালু করে বনী ইসরায়েল এবং নিজেকে ইহুদি পরিচিত দিত। পরবর্তীতে তা ধর্মীয় ও বংশগত পরিচয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
বনী ইসরায়েলের মন্দলোকদের হেদায়েত ও প্রতিহিত করার জন্য তাদের বংশধর হতে নবী, রসুল ও কিতাব দিয়েছিলেন। ফলে ক্যাবলাহ বায়তুল আকসা ছিল আর তারা দ্বীন হতে সরে যায় এবং আল্লাহ নেতৃত্ব দেন ইব্রাহিম (আ:) এর পুত্র বনী ইসমাইল এর বংশধরদের বা কোরাইশদের। এই বংশ হতে সর্বশ্রেষ্ঠ রসুল মুহাম্মদ (সা:) কে পাঠানো হয়, আর বনী ইসরায়েলের অধিকাংশই তার বিরোধিতা করে। অথচ অনেকে বিশেষ করে কোরাইশ সাহাবীরা রসুল (সা:) ও আল কুরআনের প্রতি ঈমান আনে। ফলে বনী ইসরায়েল হতে নেতৃত্ব চলে আসে বনী ইসমাইলের (কোরাইশ) কাছে এবং ক্যাবলাহও পরিবর্তন করা হয়।
মুসলিমরা কোরাইশের মুসলিমদের অনুসারী হবে। তাদের ভালোরা ভালোর নেতৃত্ব ও মন্দরা মন্দের নেতৃত্ব মেনে নিবে। যেমন – সাহাবীরা রসুলের (সা:) নেতৃত্ব মেনেছিল আর আবু জাহেলদের নেতৃত্ব মেনেছিল কাফেররা। আবার ইয়াজিদের অনুসারী বা সেনাদের অধিকাংশ ছিল মন্দ তারা তার নেতৃত্ব মেনে ছিল অপরদিকে হোসেন (রা:) ও আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা:) অনুসারীরা তার নেতৃত্ব মেনে জালেমের বিরোধিতা করেছিল। ঈসা (আ:) পর্যন্ত হয়তো এভাবে চলবে। শেষ জমানার হাদীসে পাবেন – মাহাদীর (আ) বিরুদ্ধে যে বাহিনী পাঠাবে তিনি হবেন কোরাইশি। (মুসলিম, আবুদাউদ)।
অপরদিকে আহলে বায়াত (কোরাইশ) হতে হবেন মাহাদী (হাফি:)। উম্মাহর শ্রেষ্ঠলোকগুলো তাকে মেনে নিবে।