রসুল (সাঃ), সাহাবীদের যুগে মুসলিমরা ছিল দরিদ্র্য, দুর্বল, অসহায়, তবুও প্রতিনিয়ত অসহায় নওমুসলিমদের তদারকি করতেন। তাদের যথাসাধ্য সাহায্য করতেন। নিজেদের পাশে বসিয়ে ভাই, অতিথির মত যত্ন করে খাওয়াতেন। আজ আমাদের অনেক আলেমই আছে যারা লাখ টাকা আয় করে, বহুজন নামের সাথে মুজাহিদ, জিহাদী লাগিয়েছে অথচ উম্মাহর নওমুসলিমরা আজ এত বেশী মুসলিম দাবিদার থাকা স্বত্বেও অসহায়।
আসহাবে সুফফার ঘটনা
আসহাব আল-সুফফা বা আহলুস সুফফা হল তরুণ, অবিবাহিত ও দরিদ্র সাহাবীদের একটি দলের নাম যারা সুফফা নামক স্থানে বসবাস করতেন। যা নবী মুহাম্মাদ (সা) এর মসজিদ-আল-নববীর চত্ত্বরের এক পাশে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আবু হুরাইরা (রা) ছিলেন সুফফায় বসবাসকারীদের অন্তর্ভুক্ত। হযরত আবূ হোরায়রা রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, এমন ৭০ জন আসহাবে সুফফাকে আমি দেখেছি, যাদের চাদর পর্যন্ত ছিল না, শুধু লুঙ্গি ছিল কিংবা কম্বল, যা তাঁরা গলার সঙ্গে বেঁধে রাখতেন। আর কম্বলও এত ছোট ছিল যে, কারো পায়ের গোছার অর্ধেক পর্যন্ত পৌছত, আর কারো টাখনু পর্যন্ত। আর তা তাঁরা হাত দিয়ে ধরে রাখতেন, যাতে সতর খুলে না যায়। (সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৩, نوم الرجال في المسجد এই অধ্যায়)।
হযরত আবূ হুরায়রা রা. বলেন, আসহাবে সুফফা ইসলামের মেহমান ছিলেন। তাঁদের না ছিল ঘর আর না ছিল কোনো সম্পদ। মোট কথা, তাঁদের কোনো আশ্রয়ই ছিল না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কোনো সদকা এলে, তিনি তা আসহাবে সুফফার কাছে পাঠিয়ে দিতেন, নিজের জন্য কিছুই রাখতেন না (কেননা সদকা তাঁর জন্য নিষিদ্ধ ছিল)। আর যদি হাদিয়া আসত, তা হতে নিজেও কিছু গ্রহণ করতেন এবং আসহাবে সুফফাকেও তাতে শরীক করতেন। এ সময়ে তাঁর নির্দেশটি যে, “আসহাবে সুফফাকে ডাকো” আমার মনে কিছুটা কষ্টের ভাব হলো এবং মনে মনে বললাম, মাত্র এক পেয়ালা দুধ, এ কি আসহাবে সুফফার জন্য যথেষ্ট হবে? এর সবচে’ বেশি হকদার তো ছিলাম আমিই যে কিছুটা পান করে শক্তি ও সামর্থ্য অর্জন করতাম। এখন আসহাবে সুফফা আসার পর তো তিনি আমাকেই পরিবেশন করার নির্দেশ দেবেন, আর পরিবেশনের পর আমার জন্য এর কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকবে বলে তো মনে হয় না। কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য না করে উপায় ছিল না।
সুতরাং আসহাবে সুফফাকে ডেকে আনলাম এবং তাঁর নির্দেশে এক এক করে তাঁদের ডাকলাম। সবাই তৃপ্ত হয়ে গেলেন। তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার প্রতি তাকিয়ে মুচকি হাসলেন এবং বললেন, কেবল আমি আর তুমি বাকি আছি। আমি বললাম, সম্পূর্ণ ঠিক। তিনি বললেন বসে যাও এবং পান করো। আমি পান করা শুরু করলাম আর তিনি বার বার বলতে থাকলেন, আরো পান করো, আরো পান করো। এমন কি আমি বলতে বাধ্য হলাম, কসম ওই আল্লাহর, যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন, পেটে আর কোনো জায়গা নেই।
তিনি আমার হাত থেকে পেয়ালাটি গ্রহণ করলেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করে ও বিসমিল্লাহ পাঠ করে যা বাকি ছিল, তা পান করেন। (বুখারী শরীফের কিতাবুর রিকাক-এ অধ্যায়ে হাদীসটি বর্ণিত)
হযরত আবূ হুরায়রা রা. বলেন, আমিও আসহাবে সুফফার একজন ছিলাম। সন্ধ্যা হলেই, আমরা সবাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চলে যেতাম। তিনি এক একজন, দু’ দু’জন করে ধনী সাহাবাগণের কাছে সোপর্দ করতেন। যারা বাকি থাকতো, তাদের তিনি নিজের সঙ্গে খাবারে শরীক করতেন। খাওয়ার পর আমরা রাতে মসজিদে ঘুমাতাম। (ফাতহুল বারী, كيف كان عيش النبي صلى الله عليه وسلم وأصحابه تخليهم من الدنيا অধ্যায়)
মসজিদে নববীর দুটি খুঁটির মধ্যে একটি রশি বাঁধা থাকতো। আনসার সাহাবীগণ বাগান থেকে থোকা থোকা ফল এনে আসহাবে সুফফার জন্য তাতে ঝুলিয়ে রাখতেন। আসহাবে সুফফা তা লাঠির সাহায্যে নামিয়ে খেতেন। এর ব্যবস্থাপনা ও দেখাশোনা করতেন হযরত মু’আয ইবনে জাবাল রা.।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাগণের মধ্যে আসহাবে সুফফার অসহায় সাহাবীদের ভাগ করে দিতেন এভাবে যার কাছে দু’জনের খাদ্য আছে, সে একজন এবং যার কাছে তিনজনের খাদ্য আছে, সে চতুর্থজনকে সঙ্গে নিয়ে যাবে এবং এ হিসেবে চলত।
মুহাম্মদ ইবনে সীরীন রাহ. বলেন, সন্ধ্যা হলে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসহাবে সুফফার সদস্যগণকে সাহাবী সাধারণের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। কেউ দু’জনকে নিয়ে যেত, কেউ তিনজনকে এবং এভাবে। আর হযরত সা’দ ইবনে উবাদা রা. তো আশিজনকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। এবং তাঁদের খাবার খাওয়াতেন।
আচ্ছা চিন্তা করুন, মদীনার জীবনে- সাহাবীরা খাবার ও আরামে কাটাবে অথচ উম্মাহর নওমুসলিমরা কষ্ট করবে তাও কি কখনো সম্ভব ছিল!!
তারিক বিন জিয়াদের যুদ্ধ অভিযান
স্পেনে মুসলিম শাসনের সূচনা করেছিলেন সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ। তিনিই ইউরোপ বিজয়ী প্রথম মুসলিম বীর।
৭১০ খ্রিস্টাব্দের দিকে স্পেনের ক্ষমতায় আসেন রডেরিক। রডেরিক ক্ষমতায় এলে সিউটার শাসনকর্তা জুলিয়ান, প্রথানুযায়ী তাঁর কিশোরী কন্যাকে শিক্ষার্জনের জন্য রাজদরবারে পাঠান। রডেরিক জুলিয়ানের কন্যাকে ধর্ষণ করেন।
এর ফলে জুলিয়ান বিচারের জন্য মুসলিমদের কাছে সাহায্য চান। বর্নিত আছে- প্রথমে তিনি মুসলিমদের নেতা মুসা নুসাইরকে স্পেন আক্রমনের ফলে বিভিন্ন সম্পদ লাভের লোভ দেখিয়ে বিফল হন। ফলে তার মেয়ের নির্যাতনের কথা তুলে ধরলে তারিক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে বাহিনী বের হয়।
এর ফলে, জুলিয়ানের সহায়তায়, নতুন ধর্মান্তরিত মুসলিম ও নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে গঠিত তারিকের বাহিনী ৭১১ সালের ২৯ এপ্রিল স্পেনের সীমানায় একটি পাহাড়ের নিকটে অবতরণ করেন। যা বর্তমানে জিব্রাল্টার নামে পরিচিত। জিব্রাল্টার নামটি আসলে আরবি ‘জাবাল আত তারিক’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ’তারিকের পাহাড়’। অর্থাৎ তারিকের নামানুসারেই জিব্রাল্টারের নামকরণ করা হয়।
জিব্রাল্টারে পৌঁছেই তারিক বিন জিয়াদ তার এবং তার সৈন্যদের বহনকারী সব নৌযান পুড়িয়ে দেন। এটি দেখে তার একজন সৈন্য যখন হতবুদ্ধি হয়ে তার কাছে জানতে চান, কেন তিনি এমন করলেন? তারা এখন ফিরবে কেমন করে? তারিক তখন শান্তভাবে জবাব দিয়েছিলেন, ‘ফিরে যাবার জন্য তো আমরা আসিনি। হয় বিজয় হবে নতুবা মৃত্যু’। যুদ্ধে জয়লাভের ব্যাপারে এমনই বদ্ধপরিকর ছিলেন তারিক বিন জিয়াদ।
তারিকের সেনাবাহিনীতে মাত্র ৭০০০ জন সৈন্য ছিল। তার সাথে মুসা বিন নুসাইর আরও ৫০০০ সৈন্য পাঠিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। স্পেনের সম্রাট রডেরিক তারিকের এই স্বল্প সংখ্যক সৈন্যবাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য এক লক্ষাধিক সৈন্য সমাবেশ করেছিলেন বলে জানা যায়। তবুও তারিকের অসাধারণ নেতৃত্ব, তার সৈন্যবাহীনির অসীম সাহসীকতা ও বীরত্বের কাছে হার মানতে হয়েছিল রডেরিককে।
মুসলিমরা স্পেন বিজয় করেছিল এরপর বহুবছর সেখানে শাসন করেছিল, হাজার হাজার মানুষ ইসলাম গ্রহন করেছিল। আজ ভাবলে অবাক লাগে- আমরা কতটা বীরত্বের ও মহানুভবতার অধিকারী ছিলাম অথচ সংখ্যায় ছিলাম কত নগন্য!!