দ্বীন গ্রহণে বাধা

ইসলামের ইতিহাস খুজলে যখনি কোন নবী, রসুল এমনকি কোন মুমিন দাওয়াত দিয়েছে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাড়িয়েছে পূর্বপুরুষের দ্বীনের অজুহাত। রসুলের (সা:) দ্বীনের প্রচারণায় একনিষ্ঠ সাহায্যকারী রসুলের (সা:) চাচা আবু তালেব। নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন রসুল (সা:)-কে। তার জন্য সর্বক্ষণ দুঃশ্চিন্তা ও কষ্ট সহ্য করেছেন। মৃত্যুকালে ঈমান না এনে পূর্বপুরুষের ধর্মের উপর অটল থাকেন।

ইমাম বুখারী……… ইবন মুসায়্যার তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আবূ তালিবের মৃত্যু যখন ঘনিয়ে এলো, তখন রাসূলুল্লাহ (সা) সেখানে উপস্থিত হন। আবূ জাহাল তখন সেখানে ছিল। আবূ তালিবের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘চাচা! আপনি একটিমাত্র কালেমা-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্” বলুন, সেটির ওসীলায় আমি আল্লাহর নিকট আপনার জন্যে সুপারিশ করব। একথা শুনে আবূ জাহাল ও আবদুল্লাহ্ ইবন উমাইয়া বলল, “আবূ তালিব! আপনি কি আবদুল মুত্তালিবের ধর্ম পরিত্যাগ করছেন?” তারা অনবরত একথা বলে যাচ্ছিল। সর্বশেষে আবূ তালিব বললেন, আমি আবদুল মুত্তালিবের ধর্মে অবিচল আছি।

রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, “আমাকে নিষেধ না করা পর্যন্ত আমি আপনার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেই যাব। তখনই নাযিল হল :

ما كَانَ لِلنَّبِي وَالَّذِينَ آمَنُوا أنْ يُسْتَغْفِرُوا الْمُشْرِكِينَ وَلَوْا كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَبُ الْجَحِيمِ

“আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী এবং মু’মিনদের জন্যে সংগত নয়। যখন এটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, তারা জাহান্নামী (৯ : ১১৩-১১৪) এবং নাযিল হল :
انَّكَ لا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ

“তুমি যাকে ভালবাসো ইচ্ছা করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবে না” (২৮ : ৫৬)

আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া( তয় খন্ড)

আবু লাহাব রসুলের (সা:) বিরোধিতা করেন পূর্বপুরুষদের কারনে

বায়হাকী…….. উরওয়া সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বলেছেন, আবূ তালিবের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর ভয়ে কুরায়শরা ভীত ছিল। হাকিম……. আইশা (রা) সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন । হাফিয আবুল ফারাজ ইবনুল জাওযী আপন সনদে ছা’লাবাহ ইবন সাঈর ও হাকীম ইবন হিযাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তাঁরা বলেছেন আবূ তালিব ও খাদীজা (রা) যখন ইনতিকাল করেন, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) একই সাথে এই দুইটি বিপদের সম্মুখীন হন। তাদের উভয়ের মৃত্যুর মধ্যে মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধান ছিল। তখন তিনি অধিকাংশ সময় ঘরেই থাকতেন। বের হতেন কম। ইতোপূর্বে কুরায়শরা তাঁর সাথে যে আচরণ করতে সাহস পেতো না এখন তারা সে আচরণ করতে লাগল। এ সংবাদ আবূ লাহাবের নিকট পৌঁছে। সে রসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এসে বলে, হে মুহাম্মদ! তুমি তোমার লক্ষে এগিয়ে যাও এবং আবূ তালিবের জীবদ্দশায় তুমি যা যা করতে এখনও তুমি তা করে যাও। লাত দেবীর কসম, আমার মৃত্যু পর্যন্ত ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে কেউ তোমার নিকট পৌঁছতে পারবে না। ইবন গায়তালাহ্ নামে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে গালি দিয়েছিল। আবূ লাহাব এগিয়ে গিয়ে তাকে শাস্তি দেয়। ইবন গায়তালাহ তখন চীৎকার করে কুরায়শদেরকে ডেকে বলে, হে কুরায়শ সম্প্রদায়! আবূ উতবা অর্থাৎ আবূ লাহাব পিতৃধর্ম ত্যাগ করেছে, সে ধর্মান্তরিত হয়েছে। কুরায়শরা ত্বরিতগতিতে আবূ লাহাবের বাড়িতে উপস্থিত হয়। সে বলে, আমি আমার পিতা আবদুল মুত্তালিবের ধর্ম ত্যাগ করিনি। তবে আমি আমার ভাতিজাকে সকল অত্যাচার থেকে রক্ষা করব যাতে করে সে তার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারে। তারা বলল, তাহলে তো আপনি ভাল ও মহৎ কাজ করেছেন এবং আত্মীয়তার মর্যাদা রক্ষা করেছেন। ফলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) কিছুদিন নিরাপদ রইলেন। নিজের মত করে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতে লাগলেন। আবূ লাহাবের ভয়ে কেউ তাঁকে কিছু বলতো না। এভাবে চলছিল। একদিন উকবা ইবন আবূ মুআইত এবং আবূ জাহল আবূ লাহাবের নিকট এসে উপস্থিত হল। তারা বলল, আপনি আপনার ভাতিজাকে জিজ্ঞেস করুন, সে বলুক আপনার পিতার শেষ ঠিকানা কোথায়? আবূ লাহাব বলল, হে মুহাম্মদ! আবদুল মুত্তালিবের শেষ ঠিকানা কোথায়? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তার ঠিকানা তার সম্প্রদায়ের সাথে। আবূ লাহাব ওদেরকে গিয়ে বলল, আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছি। সে বলেছে যে, আমার পিতার শেষ ঠিকানা তাঁর সম্প্রদায়ের সাথে। তারা দু’জনে বলল, সে তো বলে যে, আবদুল মুত্তালিবের শেষ ঠিকানা জাহান্নামে। এবার আবূ লাহাব বলল, হে মুহাম্মদ! আবদুল মুত্তালিব কি জাহান্নামে যাবেন? রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আবদুল মুত্তালিব যে ধর্মবিশ্বাস নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ওই ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কারো মৃত্যু হলে সে তো জাহান্নামেই যাবে। তখন অভিশপ্ত আবূ লাহাব বলল, আল্লাহর কসম, আমি চিরদিনের জন্যে তোমার শত্রু হয়ে থাকব। কারণ, তুমি বিশ্বাস কর যে, আবদুল মুত্তালিব জাহান্নামে যাবেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া- ৩য় খন্ড)

তখন থেকে আবূ লাহাব ও সমগ্র কুরায়শ সম্প্রদায় বহুগুণ নির্যাতন শুরু করে রসুলের (সা:) উপর। রসুল (সা:) মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন। এরপর তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন। তাঁর চলে যাবার পর আবূ লাহাব সেখানে উপস্থিত হল। তাঁর চাচা আবূ লাহাব তাঁর পেছনে লেগে থাকত এবং লোকজনকে বলত তোমরা তার কথা গ্রহণ করো না। বস্তুত আবূ লাহাব উপস্থিত হওয়ার পর লোকজন তাকে বলত, আপনি কি ও লোকটিকে চিনেন? আবূ লাহাব বলল, হ্যাঁ আমি তাকে চিনি। সে আমাদের মধ্যে সম্ভ্ৰান্ত ব্যক্তি। তোমরা তার সম্পর্কে কি জানতে চাচ্ছ? রাসূলুল্লাহ্ (সা) ওদেরকে যে বিষয়ে দাওয়াত দিয়েছিলেন সে সম্পর্কে তারা আবূ লাহাবকে জানাল এবং তারা বলল যে, সে নিজেকে আল্লাহর রাসূল বলে দাবী করে। আবূ লাহাব বলল, তার কথা গ্রহণ করে তোমরা তাকে উপরে তুলে দিও না। সে একজন পাগল, মাথায় যা আসে তাই বলতে থাকে। নাউজুবিল্লাহ, আল্লাহ সুরা লাহাবে স্বয়ং আবু লাহাবকে অভিশপ্ত ও ধ্বংসের সংবাদ জানান। বস্তুত আবু লাহাবদের সম্মান, জীবিকা অনেক কিছুই নির্ভর করতো পূর্বপুরুষের বিশেষ করে আবদুল মুত্তালিবের মর্যাদার উপর ভিত্তি করে। তারা কাবার কতৃত্ব, নেতৃত্ব পেত।

ওরা বিশ্বাস করত – রসুলের (সা:) দ্বীন গ্রহন করলে তাদের পূর্বপুরুষদের বিরোধিতা করলে লোকজনের নিকট তাদের সম্মান, নেতৃত্ব, কতৃত্ব শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া তাদের পূর্বপুরুষ ইব্রাহিম (আ:) ও ইসমাইল (আ:) তাওহীদ ছেড়ে বিকৃত দ্বীন মেনে চলতো। যে ইব্রাহিম (আ:) মূর্তি ভেঙ্গেছিলেন তার অনুসারী প্রচার করে তারা মূর্তিপূজাসহ শিরক, বিদআতে লিপ্ত ছিল। আজও যখন কেউ রসুলের (সা:) রেখে যাওয়া দ্বীনের পথে আহ্বান করে তা যদি তাদের পূর্বপুরুষের নামে প্রচলিত দ্বীনের বিপরীত হয় তাহলে অনেকে – পাগল, ধর্মত্যাগী, নাস্তিক, ইহুদি খ্রিস্টানদের দালাল অভিযোগ এনে দ্বীনের কার্যক্রম প্রচার, প্রসার বন্ধ করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ভুলে যায় এটা আল্লাহর দ্বীন তিনি একে প্রতিষ্ঠিত করবেনই। যারা তাকে ধ্বংস করতে আসবে তাদেরও আবু লাহাবদের মত পরিনতি বরন করতে হবে।।

আল্লাহ বলেন-

“আর যখন তাদের বলা হয়, ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তার তোমরা অনুসরণ কর।’ তারা বলে, ‘(না-না) বরং আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের যাতে (মতামত ও ধর্মাদর্শে) পেয়েছি, তার অনুসরণ করব।’ যদিও তাদের পিতৃপুরুষগণ কিছুই বুঝত না এবং তারা সৎ পথেও ছিল না।

বাকারাহঃ ১৭০

“আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার দিকে ও রাসুলের দিকে এসো,’ তখন তারা বলে, ‘আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের যাতে পেয়েছি, তাই আমাদের জন্যও যথেষ্ট।’ যদিও তাদের পূর্বপুরুষগণ কিছুই জানত না এবং সৎপথপ্রাপ্ত ও ছিলেন না, তবুও?

মায়িদাহঃ ১০৪

যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তোমরা তার অনুসরণ কর’, তখন তারা বলে, ‘আমাদের বাপ দাদাকে যাতে পেয়েছি, আমরা তো তাই মেনে চলব।’ যদিও শয়তান তাদেরকে দোজখ যন্ত্রণার দিকে আহবান করে (তবুও কি তারা বাপ দাদারই অনুসরণ করবে)?

লুকমানঃ ২১

“বরং ওরা বলে, আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদের এক মতাদর্শের অনুসারী পেয়েছি এবং আমরা তো তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে পথপ্রাপ্ত। এভাবে, তোমার পূর্বে কোন জনপদে যখনই কোন সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখনই তাদের মধ্যে যারা বিত্তশালী ছিল তারা বলত, ‘আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষকে এক মতাদর্শের অনুসারী পেয়েছি এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি।’ (প্রত্যেক সতর্ককারী) বলত, ‘তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষকে যার অনুসারী পেয়েছ, আমি যদি তোমাদের জন্য তা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট পথনির্দেশ আনায়ন করি, তবুও কি তোমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে? (প্রত্যুত্তরে) তারা বলত, ‘তোমরা যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছ, আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি।’ সুতরাং আমি ওদের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করলাম। অতএব দেখ, মিথ্যাচারীদের পরিণাম কি হয়েছে?

জুখরুফঃ ২২-২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *