দাজ্জালের ফেতনা – পর্ব ৪ (ঈমান মুক্তির দুর্গ)

মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় ফেতনা হল দাজ্জাল। দাজ্জাল হতে বাচার উত্তম উপায় হল আকীদার জ্ঞান থাকা এবং রবের সঠিক পরিচয় জানা।

আল ফিতানের ১৫১৬ নং হাদিসে এসেছে,

হযরত আবু উমামা আল বাহেলী রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেন, “যখন দাজ্জাল বাহির হবে, তখন দাজ্জাল ডানে ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে এবং বামেও ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে। হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা নত হও। কেননা দাজ্জাল সে শুরু করবে। অতঃপর সে বলবে, আমি নবী। (নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন) অথচ আমার পরে কোন নবী নেই। অতঃপর সে গুণগান করবে। অতঃপর সে বলবে, আমি তোমাদের রব বা প্রতিপালক। (নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন) অথচ তোমরা তোমাদের রব বা প্রতিপালককে মৃত্যুর পূর্বে দেখতে পাবে না। আর দাজ্জাল হবে অন্ধ। অথচ তোমাদের রব অন্ধ নন। আর দাজ্জালের দুই চক্ষুর মধ্যখানে কাফের লেখা থাকবে। যা প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তিই পড়তে পারবে। আর দাজ্জালের ফিতনাসমূহ থেকে হল- তার সাথে একটি জান্নাত ও একটি জাহান্নাম থাকবে। (আর বাস্তবতা হল) তার জাহান্নাম হল জান্নাত। আর তার জান্নাত হল জাহান্নাম। সুতরাং যে ব্যক্তি তার জাহান্নাম কর্তৃক নির্যাতিত হয়, সে যেন সূরা কাহাফের প্রথমাংশ তেলাওয়াত করে। আর যেন আল্লাহতা’লার নিকট সাহায্য কামনা করে যাতে করে দাজ্জালের আগুন বা জাহান্নাম তার উপর ঠান্ডা ও শান্তিদায়ক হয়। যেমনিভাবে আগুন ঠান্ডা ও শান্তিদায়ক হয়েছিল ইবরাহীম (আঃ) এর উপর। আর দাজ্জালের ফিতনা থেকে আরেকটি হল- তার সাথে অনেক শয়তান থাকবে। উক্ত শয়তানগুলি তার জন্য মানুষের আকৃতি ধারণ করবে। অতঃপর দাজ্জাল এক বেদুইন বা গ্রাম্য ব্যক্তির নিকট এসে বলবে (যার পিতা মাতা মারা গেছে) তুমি বল তো, যদি আমি তোমার পিতা মাতাকে ফিরিয়ে আনি তাহলে কি তুমি আমাকে তোমার রব হিসাবে সাক্ষ্য দিবে? বেদুইন লোকটি উত্তরে বলবে, হ্যাঁ। অতঃপর তার শয়তানগুলি উক্ত বেদুইন লোকের পিতা মাতার আকৃতি ধারণ করবে। অতঃপর উক্ত শয়তান দুটি বলবে, হে আমার সন্তান তুমি তাকে (দাজ্জালকে) অনুসরণ কর। কেননা সে তোমার রব বা প্রতিপালক। দাজ্জালের আরো ফিতনা হল- একজন মানুষের উপর কব্জা করে নিবে। ফলে তাকে হত্যা করবে এবং জীবিত করবে। এবং তারপর আর ফিরে আসবে না। ঐ মানুষ ব্যতীত অন্য মানুষের উপর কোন কাজ করতে পারবে না। দাজ্জাল বলবে, তোমরা আমার বান্দাকে দেখ, আমি তাকে এখন জীবিত করছি। আর সে ধারণা করে আমি ব্যতীত তার অন্য রব আছে। অতঃপর তাকে জীবিত করবে। অতঃপর দাজ্জাল তাকে বলবে, তোমার রব কে? তার উত্তরে লোকটি বলবে, আমার রব হল আল্লাহ। আর আল্লাহর শত্রু দাজ্জাল। আর তার আরেকটি ফিতনা হল- সে এক বেদুইনকে বলবে, তুমি বল তো, যদি আমি তোমার উটকে জীবিত করি তাহলে কি তুমি আমাকে তোমার রব হিসাবে সাক্ষ্য দিবে? উত্তরে লোকটি বলবে, হ্যাঁ। অতঃপর তার জন্য শয়তান তার উটের আকৃতি ধারণ করবে। (সংক্ষিপ্ত)

আজ যারা রসুলুল্লাহ’র (সা) পরে কাউকে নবী মানে বা মিথ্যা নবী মানে, তারা দাজ্জালের ফেতনায় পড়বে। যাদের বিশ্বাস মানুষ দুনিয়ায় রবকে দেখতে পারবে বা রব মানুষরূপে আসে তারা দাজ্জালের ফেতনায় পড়বে। আর আমাদের রব সর্বোত্তম সৌন্দর্য্যের অধিকারী, তিনি সবকিছু জানেন ও শুনেন, তার সমতুল্য কিছু নেই। যারা আল্লাহর সিফাত জানবে ও মানবে সঠিকভাবে ইনশাআল্লাহ দাজ্জালের ফেতনায় পড়বে না।

দাজ্জালের যুগে শয়তান মৃত ব্যক্তির (পিতামাতা, বুজুর্গ) ছদ্মবেশে এসে দাজ্জালের ইবাদত করতে বলবে ফলে ফেতনায় অনেকে ঈমানহারা হবে। তাই কারামতির নামে কুরআন সুন্নাহর বিপরীত যেকোন মতবাদ গ্রহন করা হতে সতর্ক থাকা প্রয়োজন!

শয়তানের ফেতনা আজও আছে- শয়তান স্বপ্নেও বিভিন্ন সময় পিতামাতা, আত্মীয়, বুজুর্গের ছদ্মবেশে এসে এমন কোন নির্দেশ দেয় যা শরীয়তের বিপরীত, তা গ্রহনযোগ্য নয়! যেমন শয়তান যদি মৃত পিতামাতা, বুজুর্গের বেশে এসে যদি স্বপ্ন দেখায়- অমুক বুজুর্গের নামে অমুক মাজারে পশু জবাই বা অমুক আমল যা শরীয়তে নেই করলে পিতামাতা, স্বজনদের আত্মা শান্তি পাবে বুঝতে হবে এগুলো শয়তানের ধোকা। এই বিষয়ে জিন সিরিজে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

পিতামাতা, সম্পদ, সন্তান ও দুনিয়াবী আসবাবকে ইসলামের চেয়ে প্রাধান্য দিলে দাজ্জালের ফেতনায় পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।

আল্লাহ বলেন-

হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা তোমাদের পিতা আর ভাইদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না যদি তারা ঈমানের চেয়ে কুফরীকেই বেশি ভালবাসে। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারাই যালিম। বল, ‘যদি তোমাদের পিতারা, আর তোমাদের সন্তানেরা, আর তোমাদের ভাইয়েরা, আর তোমাদের স্ত্রীরা, আর তোমাদের গোষ্ঠীর লোকেরা আর ধন-সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর ব্যবসা তোমরা যার মন্দার ভয় কর, আর বাসস্থান যা তোমরা ভালবাস (এসব) যদি তোমাদের নিকট প্রিয়তর হয় আল্লাহ, তাঁর রসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করা হতে, তাহলে অপেক্ষা কর যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর চূড়ান্ত ফয়সালা তোমাদের কাছে নিয়ে আসেন।’ আর আল্লাহ অবাধ্য আচরণকারীদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন না। (সুরা তওবা- ২৪)

আর আকীদার সঠিক ধারণা অর্জন ও ঈমান দৃঢ় নাহলে মক্কা, মদীনায় মুসলিমদের সাথে নিরাপদে বসবাস করেও দাজ্জালের ফেতনায় ঈমানহারা হবে।

যেমন আল ফিতানের হাদীসে এসেছে –

দাজ্জাল (মদীনায়) জিবরাঈল (আঃ) কে দেখবে তখন ভেগে পালাবে। অতঃপর দাজ্জাল চিৎকার দিলে পুরুষ ও মহিলা মুনাফেকরা তার সাথে যোগ দিবে। (হাদীস নং১৫২৭, সংক্ষিপ্ত)

মুসলিমের হাদিস অনুযায়ী যারা শামের মালাহামা, ইস্তাম্বুল বিজয় করবে ও গাজাওয়ে হিন্দের জীবিত মুজাহিদরা দাজ্জালের ফেতনা হতে সুরক্ষিত থাকবে!! (পূর্বে আলোচনা হয়েছে)। তাহলে যারা মক্কা, মদীনায় থেকেও পরবর্তীতে দাজ্জালের ফেতনায় পড়বে তারা হয়তো জেহাদবিমুখ হবে, হয়তো ইসলামের সুসময় দেখে মুসলিম হবার ইচ্ছে পোষন করবে। আর যখন মুসলিম ও ইসলামকে দুর্বল দেখবে এবং ভয় পাবে ইসলাম মানলে দুনিয়ার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে তখনই মুসলিমদের দল ত্যাগ করে দাজ্জালের দলে যোগ দিবে।

এই বৈশিষ্ট্যগুলো আজও অনেকের মাঝে বিদ্যমান। যখনি মুসলিমদের দুর্বল দেখে মুনাফেকরা ইসলাম ও মুসলিমদের নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করে ও মুসলিমদের ভবিষ্যৎ বিজয় নিয়ে অন্যদের অন্তরে সন্দেহ সৃষ্টি করে! আসলে বিপদ, আপদ, জেহাদে সাময়িক পরাজয় দ্বারা আল্লাহ মুমিন ও মুনাফেকেদের চরিত্র স্পষ্ট করে দেন।

হাদীসগুলো হতে বুঝা যায়- একদিকে দ্বীনী সঠিক জ্ঞান না থাকা, দুনিয়ার ফেতনা, অটল ঈমান না থাকার কারনে অনেকে দাজ্জালের দলে যোগ দিবে।

আবার মুসলিম শরীফে এসেছে –

আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন— “দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করবে, তখন মুমিনদের মধ্য থেকে একজন তার অভিমুখে বের হবে, পথিমধ্যে দাজ্জালের সশস্ত্র বাহিনী তাকে পেয়ে বসবে। তারা তাকে বলবে, “কোথায় যাচ্ছো?”

সে বলবে, “আমি এই লোকের কাছে যাচ্ছি, যে সদ্য আত্মপ্রকাশ করেছে।”

তারা তাকে বলবে, “তুমি কি আমাদের রবের ওপর ইমান রাখো না?”

সে বলবে, “আমাদের রবের ব্যাপারে তো কোনো অস্পষ্টতা নেই।”

তখন তারা বলবে, “একে মেরে ফেলো।”

তখন তাদের একদল অপরদলকে বলবে, “তোমাদের রব কি তোমাদেরকে নিষেধ করেন নি যে, তিনি ছাড়া তোমাদের কেউ যেনো কাউকে হত্যা না করে?”

তখন তারা সেই যুবককে দাজ্জালের কাছে নিয়ে যাবে। মুমিন যুবক দাজ্জালকে দেখামাত্র বলবে, “হে মানুষসকল, এই হচ্ছে সেই দাজ্জাল, যার বর্ণনা রাসুলুল্লাহ সা. দিয়ে গেছেন।”

তখন দাজ্জাল নির্দেশ দিয়ে বলবে—“তোমরা একে পাকড়াও করো, এরপর তাকে আচ্ছামতো ধোলাই দাও।”

অনন্তর সেই মুমিন যুবকের বুকে-পেটে প্রচুর প্রহার করা হবে।

এরপর দাজ্জাল বলবে, “তুমি কি আমার ওপর ইমান আনয়ন করবে না?”

তখন সে বলবে, “তুই “আলমাসিহুল কাযযাব”।

এরপর দাজ্জালের নির্দেশে তাকে করাত দিয়ে চেরা হবে। তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দ্বিখণ্ডিত করা হবে। তারপর দাজ্জাল কর্তিত টুকরা-দু’টোর মাঝ দিয়ে হেঁটে যাবে। এরপর সে তার উদ্দেশ্যে বলবে, “ওঠো”। তখন সে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াবে।

এরপর দাজ্জাল তাকে বলবে, “তুমি কি আমার ওপর ইমান আনবে না?”

তখন যুবক বলবে, “তোর ব্যাপারে আমার পর্যবেক্ষণে আরো প্রবৃদ্ধি ঘটেছে।”

এরপর যুবক বলবে, “হে মানুষ সকল, আমার পর আর কারো সাথে এরূপ করা হবে না।”

তখন দাজ্জাল তাকে জবাই করে ফেলার উদ্দেশ্যে ধরবে। সেই মুহূর্তে তার ঘাড় থেকে গলার হাড় পর্যন্ত অংশটি তামায় পরিণত হয়ে যাবে। ফলে দাজ্জাল আর কোনোভাবেই জবাই করার পথ খুঁজে পাবে না। তখন সে তার দু-হাত ও দু-পা ধরে নিক্ষেপ করবে। মানুষ ভাববে, দাজ্জাল তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করেছে। অথচ আদতে তাকে নিক্ষেপ করা হয়েছে জান্নাতে।

রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, “মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে এই যুবকই হবে সবচে মহান শাহাদাতের অধিকারী। (মুসলিম শরীফ)

তেমনি দ্বীনের প্রতি অটল ভরসা, হাদীসের সঠিক জ্ঞান থাকলে এই যুবকের মত অনেকে রক্ষা পাবে দাজ্জাল যতই ধোঁকাবাজি করুক। কারন মুমিনের অটল বিশ্বাস রিযিকদাতা, বিধানদাতা একমাত্র আল্লাহ, যা কিছু হয় আল্লাহর জ্ঞানে রয়েছে। তার অনুমতিবিহীন কিছু ঘটে না।
মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য তিনি দাজ্জালকে সাময়িক কিছু জিনিসের অনুমোদন দিয়েছেন যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি নেই, যেমনটা তিনি শয়তানকে কিছু ক্ষমতাসহ কেয়ামত পর্যন্ত অবকাশ দিয়েছেন। তেমনি কাউকে দুনিয়ার সমৃদ্ধি, জনপ্রিয়তা দিলে আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট এই ধারণা ভুল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *