দাওয়াহ ও অভিযোগ

আরদ ইবনে হুমায়দ তার মুসনাদ গ্রন্থে আবূ বকর ইবনে আবূ শায়বা…… জাবির ইবন আবদুল্লাহ্ (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, কুরায়শ বংশের লোকেরা একদিন এক পরামর্শ সভায় মিলিত হয়। তারা বলল, জাদুবিদ্যা, জ্যেতিষশাস্ত্র এবং কবিতা সম্পর্কে আমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বাধিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তাঁকে খুঁজে বের কর। সে যেন ওই লোকের নিকট যায়, যে আমাদের ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দিয়েছে এবং আমাদের ধর্মের নিন্দা করেছে। আমাদের অভিজ্ঞ লোকটি যেন তার সাথে কথা বলে এবং সে কি উত্তর দেয় তা লক্ষ্য করে। তারা বলল, এ বিষয়ে উতবা ইবন রাবীআ ব্যতীত অন্য কাউকে আমরা উপযুক্ত মনে করছি না। উতবার উদ্দেশ্যে তারা বলল, হে আবূ ওয়ালীদ আপনিই এই দায়িত্ব পালন করুন। তখন উতবা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আসে। সে বলে, হে মুহাম্মদ! তুমি উত্তম, নাকি তোমার পিতা আবদুল্লাহ্? তিনি কিছু না বলে চুপ করে রইলেন। সে এবার বলল, তুমি উত্তম, নাকি আবদুল মুত্তালিব? তিনি চুপ করে রইলেন। উতবা এবার বলল, তুমি যদি মনে কর যে, তারা তোমার চেয়ে উত্তম ছিলেন, তবে তারা তো সে সব উপাস্যের উপাসনা করে গিয়েছেন তুমি যেগুলোর নিন্দা করছ। আর তুমি যদি মনে কর যে, তুমি তাদের তুলনায় উত্তম, তবে তুমি তোমার নিজের কথা বল আমরা তা শুনি।

আল্লাহর কসম! নিজ সম্প্রদায়ের জন্যে তুমি যত ক্ষতিকর ও অলক্ষুণে ততোধিক ক্ষতিকর ও অলক্ষুণে কাউকে আমরা দেখি না। তুমি আমাদের ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছ। আমাদের সমাজের শৃঙ্খলা নষ্ট করে দিয়েছ এবং আমাদের ধর্মের নিন্দা করেছ। সমগ্র আরব দেশে এ কথা ছড়িয়ে পড়েছে যে, কুরায়শ গোত্রে একজন জাদুকরের আবির্ভাব ঘটেছে। একজন গণকের আগমন ঘটেছে। আল্লাহর কসম, আমরা এখন গর্ভবতী মহিলার প্রাণফাটা চিৎকারের ন্যায় একটি চিৎকারের আশংকায় অস্থির রয়েছি যে চিৎকার শুনে আমাদের একদল অপরদলের উপর তরবারি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ফলে আমরা সবাই ধ্বংস হয়ে যাব। ওহে, তোমার যদি কোন অভাব-অনটন থাকে, তাহলে আমরা তোমাকে প্রচুর ধন-সম্পদ সংগ্রহ করে দিব, যাতে তুমি কুরায়শ বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তি হতে পার। তোমার যদি বিয়ে-শাদী করার ইচ্ছা থাকে তবে কুরায়শ বংশের যে মহিলাকে তোমার পছন্দ হয় তার কথা বল, সে রকম দশজন মহিলা আমরা তোমার নিকট বিয়ে দিয়ে দিব। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, আপনার কথা কি শেষ হয়েছে? সে বলল, হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন :

“দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহর নামে” হা-মীম। এটি দয়াময়, পরম দয়ালুর নিকট হতে অবতীর্ণ। এটি এক কিতাব বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে এর আয়াতসমূহ আরবী ভাষায় কুরআনরূপে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্যে। সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। কিন্তু ওদের অধিকাংশই বিমুখ হয়েছে। সুতরাং তারা শুনবে না। ওরা বলে, তুমি যার প্রতি আমাদেরকে আহ্বান করছ সে বিষয়ে আমাদের অন্তর আবরণ আচ্ছাদিত, কর্ণে আছে বধিরতা এবং তোমার ও আমাদের মধ্যে আছে অন্তরাল। সুতরাং তুমি তোমার কাজ কর এবং আমরা আমাদের কাজ করি। বলুন, আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি ওহী হয় যে, তোমাদের ইলাহ্ একমাত্র ইলাহ্।

অতএব তাঁরই পথ দৃঢ়ভাবে অবলম্বন কর এবং তাঁরই নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। দুর্ভোগ অংশীবাদীদের জন্যে। যারা যাকাত প্রদান করে না এবং ওরা আখিরাতেও অবিশ্বাসী। যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্যে রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার।

বলুন, তোমরা কি তাঁকে অস্বীকার করবেই, যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন দুই দিনে এবং তোমরা তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করাতে চাচ্ছ? তিনি তো জগতসমূহের প্রতিপালক। তিনি স্থাপন করেছেন অটল পর্বতমালা ভূ-পৃষ্ঠে এবং তাতে রেখেছেন কল্যাণ এবং চার দিনের মধ্যে তার ব্যবস্থা করেছেন খাদ্যের সমভাবে যাঞ্চাকারীদের জন্যে। এরপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন যা ছিল ধূম্রপুঞ্জ বিশেষ। অনন্তর তিনি সেটিকে এবং পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে আস, ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়! ওরা বলল, আমরা এলাম অনুগত হয়ে। এরপর তিনি আকাশ জগতকে দু’দিনে সপ্তাকাশে পরিণত করলেন এবং প্রত্যেক আকাশে সেটির বিধান ব্যক্ত করলেন এবং আমি নিকটবর্তী আকাশকে সুশোভিত করলাম প্রদীপমালা দ্বারা এবং করলাম সুরক্ষিত। এটি পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহর ব্যবস্থাপনা। তবু তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলুন, আমি তো তোমাদেরকে সতর্ক করছি এবং ধ্বংসকর শাস্তির আদ ও ছামুদের শাস্তির অনুরূপ।” (সূরা ফুসিলাত : ১-১৩)।
(আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া খন্ড -৩য়, পৃ-১২৩-১২৪)

যুগ যুগ ধরে নবী, রসুলগণ যখন জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে হক্বের পক্ষে দাওয়াত দিয়েছেন তখন সত্য বুঝতে পেরেও জাহেলরা গ্রহণ না করে উল্টো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, বিভক্তি সৃষ্টিকারী, পূর্ব পুরুষদের অজুহাত ও তুলনা তুলে বিভিন্ন অপবাদ দিয়েছে।

আজও জাহেলরা স্পষ্ট সত্যের প্রমাণ পেয়েও তাই করে যাচ্ছে। আসুন এই প্রসঙ্গে কুরআনের কয়েকটি আয়াত দেখি-

“আর যখন তাদের বলা হয়, ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তার তোমরা অনুসরণ কর।’ তারা বলে, ‘(না-না) বরং আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের যাতে (মতামত ও ধর্মাদর্শে) পেয়েছি, তার অনুসরণ করব।’ যদিও তাদের পিতৃপুরুষগণ কিছুই বুঝত না এবং তারা সৎ পথেও ছিল না।”

সূরা বাকারাহঃ ১৭০

“আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার দিকে ও রাসুলের দিকে এসো,’ তখন তারা বলে, ‘আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের যাতে পেয়েছি, তাই আমাদের জন্যও যথেষ্ট ।’ যদিও তাদের পূর্বপুরুষগণ কিছুই জানত না এবং সৎপথপ্রাপ্তও ছিলেন না, তবুও?”

সূরা মায়িদাহঃ ১০৪

“যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তোমরা তার অনুসরণ কর’, তখন তারা বলে, ‘আমাদের বাপ দাদাকে যাতে পেয়েছি, আমরা তো তাই মেনে চলব।’ যদিও শয়তান তাদেরকে দোজখ যন্ত্রণার দিকে আহবান করে (তবুও কি তারা বাপ দাদারই অনুসরণ করবে)?”

সূরা লুকমানঃ ২১

“বরং ওরা বলে, আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদের এক মতাদর্শের অনুসারী পেয়েছি এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে পথপ্রাপ্ত। এভাবে, তোমার পূর্বে কোন জনপদে যখনই কোন সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখনই তাদের মধ্যে যারা বিত্তশালী ছিল তারা বলত, ‘আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষকে এক মতাদর্শের অনুসারী পেয়েছি এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি।’ (প্রত্যেক সতর্ককারী) বলত, ‘তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষকে যার অনুসারী পেয়েছ, আমি যদি তোমাদের জন্য তা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট পথনির্দেশ আনায়ন করি, তবুও কি তোমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে? (প্রত্যুত্তরে) তারা বলত, ‘তোমরা যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছ, আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি।’ সুতরাং আমি ওদের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করলাম। অতএব দেখ, মিথ্যাচারীদের পরিণাম কি হয়েছে?”

সূরা আজ-জুখরুফঃ ২২-২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *