আমাদের অনেক ভাই, বোন আছে যারা দ্বীন ইসলাম হয়তো বুঝেছে, সুন্নাতী আমল শিখেছে কিন্তু প্রায় দেখা যায়, কেউ হয়তো গোপনে দাওয়াত দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু প্রকাশ্যে সেই সব আমল করতে ভয় পায়। কেউ আবার গোপনে আমল করছে ঠিকই কিন্তু কুফর ও শিরকের প্রতিবাদে ভয় পাচ্ছে! অথচ সাহাবীরা এমন ছিলেন না। তারা বিদআত দেখলে প্রতিবাদ করতেন। তাদের দাওয়াত ও আমল ভিন্ন ছিল না।
আপনি কার ভয়ে সুন্নাহ পালনে ভয় পাচ্ছেন? আল্লাহর তুচ্ছ বান্দার, অথচ সর্বশক্তিমান আল্লাহর নৈকট্য আশা করেন! আপনি কাদের সাথে ঐক্যের জন্য সুন্নাহ ছাড়ছেন! অথচ সুন্নত প্রতিষ্ঠার জন্য সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) জীবন দিতেন। প্রিয়জনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। খেলাফতের সুন্নাতের জন্য হুসাইন (রাঃ) ও আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ) শহীদ হয়েছিলেন। আমাদের আচরণ কি সাহাবীদের (রা) মতো না বনী ইসরায়েলীদের মতো?
আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘তোমরা লোকদেরকে ন্যায়ের পথ অবলম্বন করতে বল; কিন্তু নিজেদের কথা ভুলে যাও। অথচ তোমরা কিতাব অধ্যয়ন করতে থাক। তোমরা কি বিচার-বুদ্ধিকে কোনো কাজেই লাগাও না?’
সুরা বাকারা: আয়াত ৪৪
বনী ইসরায়েলীদের বৈশিষ্ট্য ছিল এমন – তাদের অনেকে সৎ কাজের আদেশ দিত অথচ নিজে পালন করতো না।
অন্য আয়াতে মুমিনদেরকে উপদেশ প্রদান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা কেন এমন কথা বল, যা তোমরা নিজেরাই মেনে চল না? তোমরা যা করনা, তোমাদের তা বলা, আল্লাহর কাছে অতিশয় অসন্তোষজনক।’
সুরা সফ: আয়াত ২-৩
হাদিসে এসেছে- ইবনে হারেসাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে আনা হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। সেখানে তার নাড়ি-ভুঁড়ি বের হয়ে যাবে এবং সে তার চারিপাশে এমনভাবে ঘুরতে থাকবে, যেমন গাধা তার চাকির চারিপাশে ঘুরতে থাকে। তখন জাহান্নামীরা তার কাছে একত্রিত হয়ে তাকে বলবে, ওহে অমুক! তোমার এ অবস্থা কেন? তুমি না (আমাদেরকে) সৎ কাজের আদেশ, আর অসৎ কাজে বাধা দান করতে?’ সে বলবে, অবশ্যই। আমি (তোমাদেরকে) সৎকাজের আদেশ দিতাম; কিন্তু আমি তা নিজে করতাম না এবং অসৎ কাজে বাধা দান করতাম; অথচ আমি নিজেই তা করতাম!’’ (বুখারি -৩২৬৭, ৭০৯৮, মুসলিম ২৯৮৯, আহমদ ২১২৭৭, ২১২৮৭, ২১২৯৩, ২১৩১২)
আসলে বিদআতকে মেনে নিয়ে দ্বীন ইসলামের প্রতিষ্ঠা কি সম্ভব?
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটাল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০)।
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি এমন আমল করল যাতে আমার কোন নির্দেশনা নেই, তা পরিত্যাজ্য’ (মুসলিম হা/১৭১৮)।
জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হামদ ও ছালাতের পর বলেন, ‘নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ বাণী হ’ল আল্লাহর কিতাব এবং শ্রেষ্ঠ হেদায়াত হ’ল মুহাম্মাদের হেদায়াত। আর নিকৃষ্টতম কাজ হ’ল দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি এবং প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই হ’ল ভ্রষ্টতা’ (মুসলিম, মিশকাত হা/১৪১)।
আর নাসাঈতে রয়েছে, ‘প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণতি জাহান্নাম’ (নাসাঈ হা/১৫৭৮)।
ইরবায বিন সারিয়াহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একদিন আমাদের নিয়ে সালাত আদায় করলেন। আমার পরে তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে, তারা সত্বর বহু মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাতকে এবং সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদ্বীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে। তাকে কঠিনভাবে ধরবে এবং মাড়ির দাঁত সমূহ দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে। সাবধান! দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি হতে দূরে থাকবে। কেননা (দ্বীনের ব্যাপারে) যেকোন নতুন সৃষ্টি হল বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আত হল পথভ্রষ্টতা’। (আহমাদ, আবুদাঊদ, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৬৫)।
যেখানে বিদআত হতে দেখবেন সুন্নাসম্মত আমল চালিয়ে যেতে হবে আর এটাই উত্তম দাওয়াত। যার ফলে সৎ পথের অনুগামীরা ঈমান আনবে! তায়েফের দিন ছিল প্রিয় রসুলল্লাহ’(সা:) এর জীবনে সবচেয়ে কঠিনতম দিন। যখন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মারাত্নক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছেন, সেদিন তার শরীর রক্তাক্ত হয়েছিল।
ক্লান্ত পরিশ্রান্ত রসুল (সা) এর করুন অবস্থা রাবীআর পুত্র উতবা এবং শায়বার মত শত্রুরা দেখলেন – তখন তাঁর প্রতি তাদের রক্তের টান মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। আদ্দাস নামের তাদের এক খৃস্টান ক্রীতদাসকে ডেকে তারা বলল, এখান থেকে এক থোকা আঙ্গুর নিয়ে এই পাত্রে করে ওই লোকটির নিকট যাও এবং তাকে এসব খেতে বল। আদ্দাস তাই করল। আঙ্গুরের পাত্র নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সম্মুখে রেখে তা থেকে খেতে বলল। পাত্রে হাত দিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ❝বিসমিল্লাহ্❞ বললেন এবং খেতে শুরু করলেন।
আদ্দাস তাঁর চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল, এ অঞ্চলের লোকেরা তো এরূপ বাক্য উচ্চারণ করে না।
রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে বললেন। তোমার দেশ কোথায়? তোমার ধর্ম কী?
সে বলল, আমি খৃষ্টান, আমার দেশ নিনোভা। রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, তুমি পুণ্যবান ইউনুস ইবন মাত্তার দেশের লোক? আদ্দাস বলল, ইউনুস ইবন মাত্তা সম্পর্কে আপনি কী করে জানলেন?
তিনি উত্তর দিলেন, “উনি তো আমার ভাই, উনি নবী ছিলেন আর আমিও নবী। আদ্দাস মাথা ঝুঁকিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মাথা, হাত ও পা চুম্বন করতে লাগল।
এদিকে উতবা ও শায়বা একে অন্যকে বলছিল, তোমার ক্রীতদাসটিকে তো সে বিগড়ে দিয়েছে। আদ্দাস ফিরে এল। তারা তাকে বলল, হতভাগা, তোর হলোটা কী, তুই ওই লোকটির মাথায়, হাতে ও পায়ে চুমু খেলে?
সে বলল, মুনীব! দুনিয়াতে ওঁনার চাইতে উত্তম লোক অন্য কেউ নেই। উনি আমাকে এমন একটি কথা বলেছেন যা নবী ছাড়া অন্য কেউ জানে না। তারা বলল, আদ্দাস খবরদার! সে যেন তোকে তোর ধর্ম থেকে ফিরিয়ে নিতে না পারে।
কারণ, তার ধর্ম অপেক্ষা তোর ধর্মই উত্তম। ঐতিহাসিকদের মতে আদ্দাস (রা:) ঈমানের উপর অটল থাকেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া – ৩য় খন্ড)
এত কষ্ট, নির্যাতন, অপমানের পর ও তিনি সামান্য সময়ের জন্যও সুন্নত পালন ও দাওয়াত দেওয়া বন্ধ রাখেননি।
তায়েফ হতে আসার পথে রসুল (সা:) সালাতের আমল করেন, রসুলের (সা:) অজান্তেই তা হতে কুরআন শুনে জিনেরা ঈমান আনে। যা মুসলিমদের জন্য অনেক বড় বিজয় ছিল। যা পরে আল্লাহ তায়ালা রসুলকে (সা) জানিয়েছিলেন।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, দশম হিজরি বর্ষে ত্বায়েফ সফর থেকে ফেরার পথে তিনি ওকায বাজারের দিকে যাত্রাকালে নাখলা উপত্যকায় ফজরের সালাতে কুরআন পাঠ করছিলেন। তখন জিনেরা সেই কুরআন শুনে ইসলাম কবুল করল এবং তাদের জাতির কাছে ফিরে এসে বলল, হে আমাদের জাতি! আমরা এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি, যা সঠিক পথ প্রদর্শন করে। ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনো আমাদের পালনকর্তার সাথে কাউকে শরীক করব না’ (জিন ৭২/১-২)।
তেমনি আমাদের সবসময় সুন্নতের উপর অটল থাকা উচিত। আমাদের অজান্তে অনেকে হয়তো ইসলাম গবেষণা করে ঈমান আনবে। এমনকি যেসব সুন্নত হারাতে বসেছে সমাজে তা চালু করার প্রচেষ্টা করতে হবে।
রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘তোমাদের পরে এমন একটা কঠিন সময় আসছে, যখন কোন সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে ধারণকারী ব্যক্তি তোমাদের মধ্যকার পঞ্চাশ জন শহীদের সমান নেকী পাবে’ (ত্বাবারাণী কাবীর হা/১০২৪০; সহীহুল জামে হা/২২৩৪)।
আমরা অনেকে শহীদ হতে চাই! অথচ বর্তমান সমগ্র প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে গিয়ে প্রকাশ্যে সুন্নাহ পালনে ভয় পাই! আর সবচেয়ে উত্তম সুন্নত হল- তাওহীদকে পরিচিত করা ও প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা, যা প্রত্যেক নবীর সুন্নাহ ছিল!
কুরআনে বর্নিত-
“নিশ্চয় আমি প্রত্যেক জাতির নিকট রাসুল প্রেরণ করেছি, তারা যেন শুধু আল্লাহর ইবাদত করে এবং তাগুতকে বর্জন করে।”
সুরা নাহল আয়াত-৩৬
শুধু উম্মতে মোহাম্মদী (সা:) নয় বরং পূর্ববর্তী উম্মতের অনেকে প্রকাশ্যে তাওহীদ পালনের কারনে জুলুম, নির্যাতন ও শহীদ হয়েছিলেন। আল্লাহর নিকট অতি প্রিয় হয়েছিলেন! তাদের প্রকাশ্যে দ্বীনের অটল থাকার কারনে পুরাজাতির নিকট তাওহীদ পৌঁছে গিয়েছিল এবং পরবর্তী সকল জাতির জন্য তারা হলেন উদাহরণ।
ফেরাউনের মত জালেম শাসকের বিরুদ্ধে গিয়ে জাদুকররা প্রকাশ্যে ঈমান আনেন। ফলে সবার সম্মুখে প্রমান হয় – মুসা (আ:) সত্য দ্বীন নিয়ে এসেছেন, তারা হিকমাহর নামে তাওহীদকে গোপন রাখেন নি।
সুরা আরাফে এসেছে –
- যাদুকররা সেজদায় পড়ে গেল।
- বলল, আমরা ঈমান আনছি মহা বিশ্বের প্রতিপালকের (রব) প্রতি। যিনি মূসা ও হারুনের প্রতিপালক।
- ফেরাউন বলল, তোমরা কি (তাহলে) আমার অনুমতি দেয়ার আগেই ঈমান আনলে! এটা প্রতারণা, যা তোমরা এ নগরীতে প্রদর্শন করলে। যাতে করে এ শহরের অধিবাসীদিগকে শহর থেকে বের করে দিতে পার। সুতরাং তোমরা শীঘ্রই বুঝতে পারবে।
- অবশ্যই আমি কেটে দেব তোমাদের হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে। তারপর তোমাদের সবাইকে শূলীতে চড়িয়ে মারব।
- তারা বলল, আমাদেরকে তো মৃত্যুর পর নিজেদের পরওয়ারদেগারের নিকট ফিরে যেতেই হবে।
- বস্তুতঃ আমাদের সাথে তোমার শত্রুতা তো এ কারণেই যে, আমরা ঈমান এনেছি আমাদের রবের নিদর্শনসমূহের প্রতি যখন তা আমাদের নিকট পৌঁছেছে।
- হে আমাদের রব! আমাদের জন্য ধৈর্য্যের দ্বার খুলে দাও এবং আমাদেরকে মুসলিম হিসাবে মৃত্যু (শহীদী) দান কর।
(সুরা আরাফ, ১২০-১২৬)।
তেমনি আসহাবে উখদুদের বালক ইসলামকে সত্যি প্রমান করার জন্য জীবন দিয়েছেন। যার ফলে তার জাতির অনেকে ঈমান আনে। আগুনে ঝাপিয়ে পড়ে জীবন দেন কিন্তু তাওহীদ বিসর্জন দেননি বা হিকমাহর নামে নিরব ছিলো না!!
আল্লাহ বলেন-
- অভিশপ্ত হয়েছিল কুণ্ডের অধিপতিরা
- যে কুণ্ডে ছিল ইন্ধনপূর্ণ আগুন
- যখন তারা এর পাশে উপবিষ্ট ছিল
- এবং তারা মুমিনদের সাথে যা করছিল তা প্ৰত্যক্ষ করছিল।
- আর তারা তাদেরকে নির্যাতন করেছিল শুধু এ কারণে যে, তারা ঈমান এনেছিল পরাক্রমশালী ও প্রশংসার যোগ্য আল্লাহর উপর।
(সুরা আল বুরুজ আয়াত, ৪-৮)।