নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إِنّ الرّقَى، وَالتّمَائِمَ، وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ.
নিশ্চয় রুকইয়া (কোরআন-সুন্নাহ ব্যতীত কুফরী রুকইয়া), তামীমা ও তিওয়ালা শিরক। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৮৬
কুরআন বাদে অন্য কিছু দিয়ে তামীমা (তাবিজ) হারাম এই ব্যাপারে আলেমরা একমত। কিছু আলেম কুরআন দ্বারা তামীমা জায়েজ বলেন কিন্তু তারাও বলেন এটা রসুলের (সা:) ও সাহাবীরা আমল করেছেন এমন নজিরের সহীহ হাদীস।
কিছু হাদীস যেগুলো দেখানো হয় তা যঈফ বা হাদীসের ভুল ব্যাখা ও কিছু আলেমদের অভিমত।
কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত- কুরআনের নামে বিভিন্ন নকশা দ্বারা তাবিজ বা জ্বিন হাজির করা এগুলো ব্যাপকতা লাভ করে মুসলিমদের মাঝে রসুল (সা:) ও সাহাবীদের বহু যুগ পরে।
সোলোমান (আ:)-কে আল্লাহ জ্বিনদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দিয়েছিলেন আর রসুলের (সা:) কাছে এসে কিছু জ্বিন ঈমান আনে স্বেচ্ছায় তার অনুগত্য মেনে নিয়ে।
রসুল (সা:) ও সাহাবী (রা) জেহাদে বা কোন সমস্যায় জ্বিনকে হাজির করে সাহায্য চাইতেন না, বরং শয়তান জ্বিনরা যখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এসেছিল আল্লাহ ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করেন ও জ্বিনরা পালিয়ে যায়।
তুরস্ক, মিশরসহ ভারত উপমহাদেশে তাবিজ, জ্বিন হাজির করা এসব জনপ্রিয় মূলত আহমদ আল বুনির মাধ্যমে।
তার লেখা বই শামস-আল-মারিফ বা শামস আল মারিফ ওয়া লাতাইফ আল-আওয়ারিফ। শামস আল-মারিফ মানে ‘জ্ঞানের সূর্য’। বইটির ভাষা আরবি। লেখা হয়েছে প্রায় ৮০০ বছর আগে ত্রয়োদশ শতকে। আলজেরীয় সুফি সাধক পণ্ডিত আহমাদ আল-বুনি লেখক আইয়ুবি শাসনামলে মিশরে বসবাসকালে বইটি লেখেন। ১২২৫ সালের দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বইটি নিয়ে আজও কেন এত বিতর্ক!? বিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বইগুলোর একটি ‘শামস আল-মারিফ’। এর বিষয়বস্তু নিয়ে ৮০০ বছর ধরে চরম বিতর্ক চলছে। এটি যেমন বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত বই, তেমনি এটির রয়েছে কুখ্যাতিও। যারা বইটির পক্ষে তাদের কাছে এটি একটি নিগূঢ় পথনির্দেশিকার মতো। আর বিরোধীদের কাছে এটা নিতান্তই কালো জাদুর একটি সংকলন, যা পাঠককে জাদুবিদ্যার জগতে টেনে নিয়ে যায়।
এটিতে মূলত আরব ও ইসলামি বিশ্বের জাদুবিদ্যার মূল বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন আধ্যাত্মিক সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে শুরু করে জ্যোতিষশাস্ত্র, বিশেষ করে চন্দ্র সম্পর্কিত জাদু, আত্মা ও জিন নিয়ে কারবার, বর্ণমালা ও সংখ্যার জাদুকরী প্রয়োগ প্রভৃতি বিষয় বইটিতে আলোচনা করা হয়েছে।
সে কারণে সুফি পণ্ডিতের লেখা হলেও সুফিদের সবাই বইটির পঠন-পাঠনের পক্ষে নন। তবে নকশবন্দি-হাক্কানি ঘরানার কিছু সুফি গোষ্ঠী এর অধ্যয়নের বৈধতা দিয়েছে। তারা এটাকে জাদুবিদ্যার সংকলন হিসেবে ব্যবহার করে ও উচ্চ মর্যাদা দেয়। তবে যাদের গুপ্তবিদ্যা চর্চার ব্যাপারে নিষিদ্ধ আকর্ষণ রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে বইটি পড়ার ‘বিপদ’ রয়েছে। বিপদটি হচ্ছে, গুপ্তবিদ্যার চর্চা একজন মুসলিমকে সত্য ও সুন্দরের পথ থেকে জিন, জাদু-টোনা ও কুসংস্কারের অন্ধকার জগতে নিয়ে যেতে পারে। এই বইয়ে অনেক জিকির, জ্বিন হাজির করার পদ্ধতি (কুফরী কালাম) ছিল যা অনেক সুফিরা পরবর্তীতে অনুশীলন করে।
বইটিকে সাধারণত আরব বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী পুস্তক বিবেচনা করা হয়। একইভাবে পাশ্চাত্য ও প্রতীচ্যেও বইটি সমানভাবে আলোচিত ও জনপ্রিয়। জনপ্রিয় হলেও এটি ইসলামি ইতিহাসের বেশির ভাগ সময় নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি পড়তে অনুৎসাহিত করা হয়েছে।
কিন্তু এরপরও বইটির পঠন-পাঠন অব্যাহত রয়েছে। তবে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত আরব বিশ্বে বইটি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক চলছে। বইটি বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর বই কি না, এমনকি এটা পড়া হারাম কি না–এমন প্রশ্নও করে থাকেন অনেকে। এর কারণ, ইসলাম ও এর মূল ধর্মীয় উৎসগুলোর ব্যাপারে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে রহস্যময় ও গুপ্ত পন্থা অবলম্বনে যেসব বিপদ রয়েছে তার প্রতীক এই বইটি।
বিশ্বের সবচেয়ে অভিশপ্ত বইয়ের মধ্যে একটি শামস-আল মারিফ। এমনও শোনা যায় এটা জ্বিন শয়তান দ্বারা লিখিত বই। যদিও বর্তমানে যে শামস আল মারুফ পাওয়া যায় তা পরিপূর্ণ শামস আল মারুফ নয়, বিশেষজ্ঞরা বলেন তার কিছু অংশ।
এটা আশ্চর্যের কিছু না যদি এই বইয়ের শিক্ষায় বা অনুপ্রেরণায় শয়তানের হস্তক্ষেপ থাকে। কারন সোলেমান (আঃ) এর যুগ হতে ইহুদিরা এরূপ কুফরী কালাম অনুসরন করত পরবর্তীতে আব্রাহাম আবু লাফিয়ার মাধ্যমে কাব্বালাহ (যিনি নিজেকে মাসীহ বা নবী দাবি করেন) ইহুদি সমাজে জাদুবিদ্যার অনুশীলন বৃদ্ধি পায়। ইস্তাম্বুল, দাজ্জাল, ডনমে পোস্টে কিছু ধারণা দেওয়া আছে আব্রাহাম আবু লুফিয়া সম্পর্কে।
আল্লাহ বলেন-
আর সুলাইমানের রাজত্বে শয়তানরা যা আবৃত্তি করত তারা তা অনুসরণ করেছে। আর সুলাইমান কুফরী করেননি, বরং শয়তানরাই কুফরী করেছিল। তারা মানুষকে শিক্ষা দিত জাদু ও (সে বিষয় শিক্ষা দিত) যা বাবিল শহরে হারূত ও মারূত ফিরিশতাদ্বয়ের উপর নাযিল হয়েছিল। তারা উভয়েই এই কথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিত না যে, ‘আমরা নিছক একটি পরীক্ষা; কাজেই তুমি কুফরী করো না’। তা সত্বেও তারা ফিরিশতাদ্বয়ের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত যা দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাতো। অথচ তারা আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত তা দ্বারা কারো ক্ষতি করতে পারত না। আর তারা তা-ই শিখত যা তাদের ক্ষতি করত এবং কোন উপকারে আসত না। আর তারা নিশ্চিত জানে যে, যে কেউ তা খরিদ করে, (অর্থাৎ জাদুর আশ্রয় নেয়) তার জন্য আখেরাতে কোন অংশ নেই। যার বিনিময়ে তারা নিজেদের বিকিয়ে দিচ্ছে, তা খুবই মন্দ, যদি তারা জানত!
সুরা বাকারাহ-১০২
জাদু এমন এক বিষয়কে বলা হয়, যার উপকরণ নিতান্ত গোপন ও সূক্ষ্ম হয়ে থাকে। জাদু এমন সব গোপনীয় কাজের মাধ্যমে অর্জিত হয়, যা দৃষ্টির অগোচরে থাকে। জাদুর মধ্যে মন্ত্রপাঠ, ঝাড়ফুঁক, বাণী উচ্চারণ, ঔষধপত্র ও ধুম্ৰজাল – এসব কিছুর সমাহার থাকে। জাদুর বাস্তবতা রয়েছে। ফলে মানুষ কখনো এর মাধ্যমে অসুস্থ হয়ে পড়ে, কখনো নিহতও হয় এবং এর দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতাও সৃষ্টি করা যায়। তবে এর প্রতিক্রিয়া তাকদীরের নির্ধারিত হুকুম ও আল্লাহর অনুমতিক্রমেই হয়ে থাকে। এটা পুরোপুরি শয়তানী কাজ! এ প্রকার কাজ শির্কের অন্তর্ভুক্ত। দুটি কারণে জাদু শির্কের অন্তর্ভুক্ত।
১. এতে শয়তানদের ব্যবহার করা হয়। তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা হয় এবং তাদের পছন্দনীয় কাজের মাধ্যমে তাদের নৈকট্য অর্জন করা হয়।
২. এতে গায়েবী ইলম ও তাতে আল্লাহর সাথে শরীক হবার দাবী করা হয়। আবার কখনো কখনো জাদুকরকে বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে বিশ্বাস করা হয়। এ সবগুলোই মূলতঃ ভ্রষ্টতা ও কুফরী। তাই কুরআনুল করীমে জাদুকে সরাসরি কুফরী-কর্ম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের জ্বিন সিরিজে বিস্তারিত পাবেন।
ইয়াহুদীরা আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর অঙ্গীকারের কোন পরোয়া তো করলই না, উপরন্তু শয়তানের অনুকরণ করে তারা যোগ-যাদুর উপর আমল করতে লাগল। শুধু তাই নয়; বরং তারা এ দাবীও করল যে, সুলাইমান (আঃ) কোন নবী ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন যাদুকর এবং যাদুর জোরেই তিনি রাজত্ব করেছেন। (নাউযু বিল্লা-হ) মহান আল্লাহ বললেন, সুলাইমান (আঃ) যাদুর কার্যকলাপ করতেন না। কারণ, তা কুফরী। কুফরী কাজের সম্পাদন সুলাইমান (আঃ) কিভাবে করতে পারেন?
কথিত আছে যে, সুলাইমান (আঃ)-এর যামানায় যাদুর কার্যকলাপ ব্যাপক হয়ে গিয়েছিল। সুলাইমান (আঃ) এ পথ বন্ধ করার জন্য যাদুর কিতাবগুলো সংগ্রহ করে তাঁর আসন অথবা সিংহাসনের নীচে দাফন করে দেন। সুলাইমান (আঃ)-এর মৃত্যুর পর শয়তান ও যাদুকররা ঐ কিতাবগুলো বের করে কেবল যে মানুষদেরকে দেখালো তা নয়, বরং তাদেরকে বুঝালো যে, সুলাইমান (আঃ)-এর রাজশক্তি ও শৌর্যের উৎস ছিল এই যাদুরই কার্যকলাপ। আর এরই ভিত্তিতে ঐ যালেমরা সুলাইমান (আঃ)-কে কাফের সাব্যস্ত করল। মহান আল্লাহ তারই খন্ডন করেছেন। (ইবনে কাসীর ইত্যাদি) আর আল্লাহই ভালো জানেন।
আল্লাহর ৯৯ নাম-এ জাদুর ব্যবহার
সুফি ধারার পণ্ডিতদের মতে, অন্যান্য ইসলামি টেক্সট বা গ্রন্থগুলোর মতো কোরআনের ভাষা ও শব্দগুলোর বাহ্যিক বা প্রকাশ্য অর্থের পাশাপাশি একটা ‘লুক্কায়িত’ অর্থ রয়েছে। এই লুক্কায়িত অর্থগুলো এমন সত্যের প্রকাশ ঘটায়, যা ওই গ্রন্থ ভাসা ভাসা পড়লে এসব অর্থ অনুদ্ঘাটিত থেকে যেতে পারে।
এ কারণে সুফিরা তাদের পবিত্র গ্রন্থগুলো সম্পূর্ণরূপে বোঝার জন্য অনেক সময় ও শ্রম ব্যয় করেন। যেহেতু পবিত্র কোরআনই তাদের মনোযোগের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু, তাই এতে উল্লিখিত আল্লাহর ৯৯টি নামও (যাকে আরবিতে ‘আসমা আল-হুসনা’ বলা হয়) তাদের আগ্রহের মূলে রয়েছে।
মুসলিমদের বিশ্বাস, এই নামগুলো আল্লাহর বিভিন্ন গুণাবলি বর্ণনা করে। যেমন, পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত আল্লাহর অন্যতম নাম আর-রহমান যার অর্থ ‘পরম করুণাময়’। একইভাবে আল-খালিক যার অর্থ সৃষ্টিকর্তা।
সুফিরা বিশ্বাস করেন, এই নামগুলো একটা আধ্যাত্মিক শক্তিও বহন করে। আল-বুনির শামস আল-মারিফ হচ্ছে আল্লাহর সেই ৯৯টি নামের বৈশিষ্ট্য এবং সেগুলো ব্যবহারের একটি মহা সংকলনগ্রন্থ।
আল বুনি লিখেছেন, আল্লাহর প্রতিটি নামে একটি নির্দিষ্ট শক্তি যুক্ত রয়েছে। তাই কোনো মুমিন বান্দা যদি ‘আল-আলিম’ (আল্লাহর অন্যতম নাম, যার অর্থ জ্ঞানী) একটি নির্দিষ্ট সংখ্যকবার পাঠ করে, তাহলে সে ঐশ্বরিক জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশাধিকার পায়। একইভাবে ‘আল-কাউয়ি’ (আল্লাহর আরেকটি নাম যার মানে শক্তিশালী) পাঠ করলে ঐশ্বরিক সুরক্ষা পাওয়া যায়।
আলজেরীয় বংশোদ্ভূত এ পণ্ডিত আরও দাবি করেন, এই ঐশ্বরিক নামগুলোর জিকিরে অতীতে নানা অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। যেমন, মৃতদের জীবিত করে তোলার অলৌকিক ঘটনা ও হজরত ঈসা (আ.) ও মুসা (আ.)-এর আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার ক্ষমতা। এসব দাবি মূলধারার সুফি বিশ্বাসের সঙ্গে মিল রয়েছে।
তাদের দাবি অদ্ভুতভাবে এসব নামের কিছু জিকির করলে আত্মা রুহানি জগতে প্রবেশ ফলে এমন গুপ্ত বিদ্যা অর্জন করে যা সাধারণ মুসলিম পারে না অথচ এসব জিকির রসুল (সা:) সাহাবিদের (রা:) সুন্নাহ দ্বারা প্রামানিত নয়।
তবে বইটি নিয়ে তখনই বিতর্ক ও সমালোচনা শুরু হয়, যখন আল-বুনি আল্লাহর নাম ব্যবহার করে তাবিজ তৈরির বিষয়ে বিভিন্ন নির্দেশিকা ও সংখ্যাতত্ত্বের মতো জাদুবিদ্যার বিভিন্ন কৌশলের কথা লেখেন। শুধু তাই নয়, ফসল ও সম্পদ বৃদ্ধি এবং ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পাওয়ার মতো বিচিত্রসব বিষয়ের তাবিজ-কবজের কথা বইটিতে রয়েছে।
জাদুর (স্কয়ার) বর্গ ও জিনসাধনা
শুরুতেই বলা হয়েছে যে, বইটিতে জাদুবিদ্যার মৌলিক বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপন করা হয়েছে। এর প্রথম সংস্করণের দুটি অধ্যায়জুড়েই নানা রঙের টেবিল, প্রার্থনা চার্ট ও সংখ্যাতাত্ত্বিক সাইফার বা সংকেত দিয়ে ভরা, যা বিভিন্ন ভাষা ও শব্দের লুক্কায়িত অর্থ বের করতে ব্যবহার করা হয়েছে।
আহমাদ আল বুনি গণিতবিদ ছিলেন। কোরআনের ২৮টি হরফ নিয়ে তিনি একটি তত্ত্ব দিয়েছিলেন যে, আরবি অক্ষরের সব কটিরই সংখ্যাগত মান রয়েছে। যে যুক্তি তিনি তুলে ধরেছিলেন কোরআনে উল্লিখিত বিভিন্ন রহস্যময় অক্ষর সমষ্টির রেফারেন্সের মাধ্যমে। ‘মুকাত্তাআত’ নামে পরিচিত ওই রহস্যময় অক্ষর সমষ্টি, যার মাধ্যমে কোরআনের ১১৪টি সুরার মধ্যে ২৯টি শুরু হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ কোরআনের দীর্ঘতম সুরা আল বাকারাহ ‘আলিফ, লাম, মিম’ অক্ষরগুলো দিয়ে শুরু হয় এবং সুরা মরিয়ম শুরু হয় ‘কাফ, হা, ইয়া, আইন, ছোয়াদ’ দিয়ে। আপাত অর্থহীন এই অক্ষরগুলোরও একটা রহস্যময় অর্থ ও এমনসব বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলে মনে করা হয়, যা মুমিনের ইচ্ছা পূরণ করতে পারে।
অথচ আল্লাহ বলেন – (আলে ইমরান : ৭) তিনিই তোমাদের প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছেন৷ এ কিতাবে দুই ধরনের আয়াত আছেঃ এক হচ্ছে, মুহ্কামাত, যেগুলো কিতাবের আসল বুনিয়াদ এবং দ্বিতীয় হচ্ছে, মুতাশাবিহাত৷ যাদের মনে বক্রতা আছে তারা ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সবসময় মুতাশাবিহাতের পিছনে লেগে থাকে এবং তার অর্থ করার চেষ্টা করে থাকে৷ অথচ সেগুলোর আসল অর্থ আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না ৷ বিপরীত পক্ষে পরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারীরা বলেঃ ‘‘আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি, এসব আমাদের রবের পক্ষ থেকেই এসেছে’’। আর প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানবান লোকেরাই কোন বিষয় থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে৷
শামস আল-মারিফে অক্ষর ও সংখ্যা ব্যবহার করে আল-বুনি বিস্তৃত চার্ট তৈরি করেছেন, যা বিশেষ পদ্ধতিতে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। যদিও আল-বুনির যুগের কয়েক শতাব্দী আগেই ভারত ও ইরাকের মতো অঞ্চলে এই জাদুর বর্গ ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু তার (আল-বুনির) কাজগুলো ছিল প্রথম গুপ্ত সংকেতগুলোর অন্যতম, যা মুসলিমদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
এই ধারণাগুলো ১৫ শতক নাগাদ সুফিদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এগুলো এতটাই ব্যাপক হয়ে ওঠে যে, সংখ্যাতাত্ত্বিক চার্টগুলো পরে ভারতে সেনাদের উর্দির নিচের কাপড়ে পর্যন্ত অনুলিপি করা হতো।
কারো ঝাড়ফুঁক করার জন্য কীভাবে ফেরেশতা ও ভালো জিন ডেকে আনতে হয়, সে বিষয়েও নানা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন আল-বুনি। একই সঙ্গে কেউ যেন ভুলবশত খারাপ জিনকে ডেকে না ফেলে সেই সতর্কতাও উল্লেখ করেছেন তিনি।
আজ বিভিন্ন তাবিজ এমনকি অনেক কুরআনের ভিতর সরাসরি কুরআনের সুরা থাকে না। খেয়াল করে দেখবেন বিভিন্ন স্কয়ার, ত্রিভুজ, আরবি বর্ন, সংখ্যা থাকে, এটা রসুল (সা:) ও সাহাবীদের পথ নয় বরং আল বুনিদের তৈরি পথ।
তারা বলে এসব সংখ্যা যেমন ৭৮৬ দ্বারা বিসমিল্লাহ বুঝায়, এগুলো সাংকেতিক শব্দ, এগুলোর গুরুত্ব আছে। কিন্তু রুকইয়া বিশেষজ্ঞদের দাবি ওরা দ্বৈত শব্দ ব্যবহার করে, এগুলো কোন কুফরী অর্থ বহন করে কিন্তু ওরা মুসলিমদের বুঝানোর জন্য এসব প্রচার করে যেমনটা ইহুদিরা করত।
আল্লাহ বলেন,
হে মুমিনগণ! তোমরা ‘রা’এনা’ বলো না, বরং উনযুরনা বলো এবং শোন। আর কাফেরদের জন্য যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি রয়েছে।
সূরা বাকারা, ১০৪
‘রা’এনা’ শব্দটি আরবী ভাষায় নির্দেশসূচক শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে ‘আমাদের প্রতি লক্ষ্য করুন’। সাহাবাগণ এ শব্দটি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ক্ষেত্রে ব্যবহার করত। কিন্তু এ শব্দটি ইয়াহুদীদের ভাষায় এক প্রকার গালি ছিল, যা দ্বারা বুঝানো হতো বিবেক বিকৃত লোক। তারা এ শব্দটি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানে উপহাসসূচক ব্যবহার করত। মুমিনরা এ ব্যাপারটি উপলব্ধি না করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শানে ব্যবহার করা শুরু করে, ফলে আল্লাহ তা’আলা এ ধরণের কথাবার্তা বলতে নিষেধ করে আয়াত নাযিল করেন।
অন্য আয়াতে এ ব্যাপারটিকে ইয়াহুদীদের কুকর্মের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। বলা হয়েছে,
“ইয়াহুদীদের মধ্যে কিছু লোক কথাগুলো স্থানচ্যুত করে বিকৃত করে এবং বলে, শুনলাম ও অমান্য করলাম এবং শোনে না শোনার মত; আর নিজেদের জিহবা কুঞ্চিত করে এবং দ্বীনের প্রতি তাচ্ছিল্ল করে বলে, ‘রা’এনা’। কিন্তু তারা যদি বলত, শুনলাম ও মান্য করলাম এবং শুন ও আমাদের প্রতি লক্ষ্য কর, তবে তা তাদের জন্য ভাল ও সংগত হত। কিন্তু তাদের কুফরীর জন্য আল্লাহ তাদেরকে লা’নত করেছেন। তাদের অল্প সংখ্যকই বিশ্বাস করে।
সূরা আন-নিসা ৪৬
অথচ রসুল (সা:) বিভিন্ন সমস্যার জন্য ইস্তেখারা শিখিয়েছেন, তাবিজ বা জ্বিন দ্বারা উপকৃত হওয়া নয়।
হাদিসে এসেছে-রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, যখন তোমাদের কেউ কোনো কাজের ইচ্ছা করে তখন সে যেন ফরজ নামাজ ছাড়া দুই রাকাআত নামাজ আদায় করে নেয়। এরপর (এই) বলে (দোয়া করে)-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيمِ فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلاَ أَقْدِرُ وَتَعْلَمُ وَلاَ أَعْلَمُ وَأَنْتَ عَلاَّمُ الْغُيُوبِ اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعِيشَتِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي فِي عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ فَيَسِّرْهُ لِي ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ شَرٌّ لِي فِي دِينِي وَمَعِيشَتِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي فِي عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ فَاصْرِفْهُ عَنِّي وَاصْرِفْنِي عَنْهُ وَاقْدُرْ لِيَ الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ أَرْضِنِي بِهِ
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার জ্ঞানের সাহায্য চাইছি, তোমার শক্তির সাহায্য চাইছি এবং তোমার মহান অনুগ্রহ চাইছি। তুমিই শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী, আমার কোনো ক্ষমতা নেই। তুমি অফুরন্ত জ্ঞানের অধিকারী, আমার কোনো জ্ঞান নেই। তুমি অদৃশ্য বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে ও সম্যকভাবে জানো। হে আল্লাহ! তুমি যদি এ কাজটি আমার জন্য, আমার দ্বীনের দৃষ্টিকোণ থেকে, আমার জীবন যাপনের ব্যাপারে এবং আমার কাজের পরিণামের দিক থেকে অথবা আমার দুনিয়া ও আখিরাতের ব্যাপারে ভালো মনে কর; তবে তা আমার জন্য নির্দিষ্ট করে দাও এবং আমার জন্য সহজ করে দাও।’ (বুখারি)
ইনশাআল্লাহ আল্লাহ যা উত্তম সে সিদ্ধান্তে আপনাকে অটল রাখবেন হয়তো স্বপ্নের মাধ্যমেও নির্দেশনা পেতে পারেন।
এছাড়া বদনজর, জ্বিনঘটিত সমস্যা হতে বাচার জন্য আয়াতুল কুরসী, তিনকুল, সুরা ফাতেহা সহ কিছু দোয়া আছে আমল করা উচিত ।
যেমন –
حَدَّثَنَا عُثْمَانُ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ، حَدَّثَنَا جَرِيرٌ، عَنْ مَنْصُورٍ، عَنِ الْمِنْهَالِ بْنِ عَمْرٍو، عَنْ سَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ : كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يُعَوِّذُ الْحَسَنَ وَالْحُسَيْنَ : ” أُعِيذُكُمَا بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لاَمَّةٍ ” . ثُمَّ يَقُولُ : ” كَانَ أَبُوكُمْ يُعَوِّذُ بِهِمَا إِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ ” . قَالَ أَبُو دَاوُدَ : هَذَا دَلِيلٌ عَلَى أَنَّ الْقُرْآنَ لَيْسَ بِمَخْلُوقٍ .
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাসান ও হুসাইন (রাঃ)-এর জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করতেন এভাবে : “আমি তোমাদের দু’জনের জন্য আল্লাহ্র পূর্ণাঙ্গ কালেমাসমূহের মাধ্যমে প্রত্যেক শয়তান ও বিষাক্ত প্রাণী হতে এবং সকল প্রকার বদনজর হতে মুক্তি চাইছি”। অতঃপর তিনি বলতেন, তোমাদের পিতা (ইবরাহীম আঃ)-ও ইসমাঈল এবং ইসহাক্ব (আঃ) উভয়ের জন্য এ দু’আ পড়ে আশ্রয় চাইতেন। ইমাম আবূ দাঊদ (রহঃ) বলেন, এতে প্রমাণিত হয় যে, আল-কুরআন মাখলুক নয়।
আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৭৩৭
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস