তাকদ্বীর পর্ব-১ (পরিচিতি)

ঈমানের ছয়টি রুকনের মধ্যে তাক্বদীর অন্যতম। ঈমানের এ গুরুত্বপূর্ণ রুকনটির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করা পর্যন্ত কেউ মুমিন হতে পারবে না। মহান আল্লাহ বলেন,

‘নিশ্চয় প্রত্যেকাটি জিনিসকে আমরা ‘ক্বাদর’ তথা পরিমিতরূপে সৃষ্টি করেছি’

আল-ক্বামার ৪৯

ইবনু কাছীর (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, আহলে সুন্নাতের আলেমগণ এই আয়াত দ্বারা তাক্বদীর সাব্যস্ত হওয়ার দলীল গ্রহণ করেন। (তাফসীর ইবনে কাছীর (রিয়ায: দারু ত্বায়বাহ, দ্বিতীয় প্রকাশ: ১৯৯৯ইং), ৭/৪৮২)

অন্য আয়াতে এসেছে,

‘আর আল্লাহর বিধান সুনির্দিষ্ট, অবধারিত’

আল-আহযাব ৩৮

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু কাছীর (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বিষয় অবশ্যই ঘটবে, এর সামান্যতম কোন ব্যত্যয় ঘটবে না। তিনি যা চান, তা ঘটে। আর যা তিনি চান না, তা ঘটে না।

তাকদ্বীরকে কেন্দ্র করে বহুমত দলের সৃষ্টি হয়েছে।
কেউ তাকদ্বীর নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে আবার কেউ তাকদ্বীরকে অস্বীকার করেছে।

আলোচনা ও বিতর্ক

কোথাও বলা হয়েছে তাকদ্বীর নিয়ে বিতর্ক করতে না তেমনি আবার কোথাও তাকদ্বীরের আলোচনায় উৎসাহ দেওয়া আছে।

● রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,
‘আমার ছাহাবা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-এর কথা উঠলে তোমরা আলোচনায় প্রবৃত্ত হবে না। তারকারাজির বিধিবিধান, প্রভাব ইত্যাদি বিষয়ে কথা উঠলে তোমরা আলোচনায় প্রবৃত্ত হবে না। অনুরূপভাবে তাক্বদীর সম্পর্কে কথা উঠলে তোমরা আলোচনায় প্রবৃত্ত হবে না’। (ত্ববারাণী, আল-মু’জামুল কাবীর, তাহক্বীক: হামদী আব্দুল মাজীদ সিলাফী (কায়রো: মাকতাবাতু ইবনে তায়মিইয়াহ, তা.বি.), ১০/২৪৩, হা/১০৪৪৮; শায়খ আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন (সিলসিলাহ ছহীহাহ, ১/৭৫, হা/৩৪))

● আবু হুরায়রাহ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘আমরা তাক্বদীর নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করছিলাম, এমন সময় আমাদের নিকট রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আসলেন। অতঃপর তিনি ভীষণ রেগে গেলেন, রাগের প্রচণ্ডতায় তাঁর চেহারা মোবারক লাল হয়ে গেল; মনে হচ্ছিল, তাঁর কপালদ্বয়ে ডালিম ভেঙ্গে তার রস লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এরপর তিনি বললেন, তোমরা কি এমন তর্ক-বিতর্ক করার জন্য আদিষ্ট হয়েছ নাকি আমি এ মর্মে তোমাদের নিকট প্রেরিত হয়েছি! তোমাদের পূর্ববর্তীরা তো তখনই ধ্বংস হয়েছিল, যখন তারা এ বিষয়ে ঝগড়া করেছিল। তোমাদের প্রতি আমার কঠোর নির্দেশ রইলো যে, তোমরা এ নিয়ে তর্ক করবে না’। (তিরমিযি)।

অথচ রসুল (সাঃ) তাকদ্বীর নিয়ে আলোচনা করেছেন।
আসুন, আলেমদের মতে হাদীসের ব্যাখা দেখি।

ইবনে মাসউদ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বর্ণিত উক্ত হাদীছেই আমরা আমাদের এ মতের পক্ষে বক্তব্য পাই। কেননা হাদীছটিতে বলা হয়েছে, ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-এর কথা উঠলে তোমরা আলোচনায় প্রবৃত্ত হবে না। তার মানে কি এই যে, তাঁদের মর্যাদা-মাহাত্ম্যের কথা বলা যাবে না? নিশ্চয়ই তা নয়। বরং এখানে তাঁদের মাঝে সৃষ্ট মতানৈক্য, কলহ-দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাক্বদীরের ক্ষেত্রেও বিষয়টি ঠিক তদ্রূপই।

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ হাদীছে ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম) কে তাক্বদীর নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে নিষেধ করেছেন। কারণ তর্ক-বিতর্ক হলে মতানৈক্য সৃষ্টি হয় আর মতানৈক্য সৃষ্টি হলে সেখানে অসত্য প্রবেশ করে। তবে ভ্রান্ত ফের্কাগুলির বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের জবাব দেওয়া নিষিদ্ধ আলোচনার অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং তা হক্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সংগ্রামের অন্তর্ভুক্ত।

মূলত গায়েব বা অদৃশ্যের জ্ঞান আল্লাহর কাছে। যে জিনিস আল্লাহ সুস্পষ্ট জানিয়েছেন তা নিয়ে আলোচনা করা ফজিলতের ও শিক্ষনীয়। এতে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, আস্থা অর্জিত হয় এবং ইসলামের প্রতি বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।

আর যে জিনিস আল্লাহ আড়াল রেখেছেন তা নিয়ে বিতর্ক করা জাহেলিয়াত। বহু চেষ্টা সত্ত্বেও তাক্বদীরের সবকিছু বুঝা সম্ভব নয়। কারণ, তাক্বদীরের জ্ঞান গায়েবী বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত; যা আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ জানেন না। তিনি যদি কাউকে না জানিয়ে থাকেন, তবে অন্যরা সেটা কিভাবে জানবে?

এমনকি আল্লাহর নিকটতম কোন ফেরেশতা এবং নবী-রাসূলগণও (আলাইহিমুস সালাম) গায়েবের কোনই খবর রাখেন না।

সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ স্বয়ং রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে লক্ষ্য করে মহান আল্লাহ বলেন,

‘আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু আল্লাহ চান, তা ব্যতীত। আর আমি যদি গায়েবের কথা জানতাম, তাহলে অনেক কল্যাণ অর্জন করতে পারতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করতে পারত না। আমি ঈমানদারগণের জন্য শুধুমাত্র একজন ভীতিপ্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা বৈ আর কিছুই নই’

আল আ’রাফ: ১৮৮

মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে তাক্বদীরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে গভীর চিন্তা করলে পথভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। অতএব একজন প্রকৃত মুমিনের আল্লাহর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। একজন মুমিনকে রীতিমত সৎকর্ম করে যেতে হবে এবং অসৎকর্ম বর্জন করতে হবে।

তাকদ্বীর সিরিজের পোস্টগুলো দেখুন

1 Comment

  • তাক্বদির কি আমাদের কর্ম দারা নিয়ন্ত্রিত??

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *