তাওয়াক্কুল আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো, ভরসা করা, নির্ভর করা। তাওয়াক্কুলের সংজ্ঞা হলো: আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করা। ইসলামে আল্লাহ তা‘আলার ওপর তাওয়াক্কুল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমাদের অনেকের অভিযোগ – আমি আল্লাহর উপর ভরসা করি তাহলে বিপদ, আপদ কমছে না কেন!? আসলে আমরা তাওয়াক্কুলের মর্ম অনুভব করিনি। তাওয়াক্কুল মানে এই নয় যে আপনার-আমার উপর বিপদ-আপদ আসবে না বরং বিপদ-আপদ আসবে তবুও আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ ভরসা থাকবে, তিনিই রক্ষাকর্তা। তাহলে বিপদে ঈমান দৃঢ় থাকবে।
নবী, রসুলদের উপর একের পর এক বিপদ, পরীক্ষা এসেছে তারা হতাশ না হয়ে আল্লাহর উপর ভরসা ও দোয়া করেছেন। কোন ব্যক্তির কাছে সম্পদ আছে সে বলল- রিযিকের জন্য আমি আল্লাহর উপর ভরসা করি এটা তার তাওয়াক্কুলের পরীক্ষা নয়!!? বরং আল্লাহ কারো সম্পদ নিয়ে বা দারিদ্র্যতা দিয়ে পরীক্ষা করলো আর প্রতিনিয়ত তাকে অসৎ, হারাম আয়ের প্ররোচনা দেওয়া হচ্ছে – তবুও সে সৎ পথে অটল রয়েছে, আল্লাহর প্রতি ভরসা করছে, এটাই তার তাওয়াক্কুলের পরীক্ষা।
তাওয়াক্কুল সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি হয় দাওয়াত ও জেহাদে। জালেম শাসকের বিরুদ্ধে সত্যি বলা উত্তম জেহাদ। ইব্রাহিম (আঃ), মুসা (আঃ), রসুল (সাঃ) ফেরাউন, নমরুদ, রুম সম্রাট ও আবু জাহেলদের বিপক্ষে দাড়িয়ে সত্য বলে গেছেন শুধুমাত্র আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে।
জালেম শাসকের বিরুদ্ধে সত্য বলার ক্ষেত্রে সাধারণ জেহাদের চেয়ে বেশি তাওয়াক্কুলের পরীক্ষা হয়। কারণ জেহাদে সঙ্গী, অস্ত্র, নিরাপত্তার কিছু অবস্থা থাকে আর জালেমের বিরুদ্ধে সত্য বলার ক্ষেত্রে দেখা যায় – অসহায়-সঙ্গীহীন হয়ে শুধুমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হয়।
অপরদিকে জেহাদ ও দাওয়াতে মুনাফেক চেনা সহজ হয়। যে ধরনের সত্যি বললে বা জেহাদ করলে নিজের জীবন, সম্পদ, সন্তানের উপর আঘাত আসার সম্ভাবনা থাকে তখন তা এড়িয়ে চলা হলে বুঝতে হবে সে আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুল করেনি।
আল্লাহ বলেন-
“বলুন, তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তার রাসূল এবং তাঁর (আল্লাহর) পথে জিহাদ করার চেয়ে বেশী প্রিয় হয় তোমাদের পিতৃবর্গ, তোমাদের সন্তানরা, তোমাদের ভ্রাতাগণ, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের আপনগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশংকা কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালবাস। তবে অপেক্ষা কর আল্লাহ্ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না।”
সূরা তওবা
আল্লাহ আরো বলেন-
“আর মুমিনগণ যখন সম্মিলিত বাহিনীকে দেখল তখন তারা বলল, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের যে ওয়াদা দিয়েছেন এটি তো তাই। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্যই বলেছেন’। এতে তাদের ঈমান ও ইসলামই বৃদ্ধি পেল।”
সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২২
“আর তুমি ভরসা কর এমন চিরঞ্জীব সত্তার ওপর যিনি মরবেন না।”
সূরা আল ফুরকান, আয়াত: ৫৮
কুরআনে বর্নিত, ইব্রাহিম (আঃ) কঠিন বিপদেও একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা রেখেছেন যখন জালেম শাসকসহ পুরোজাতি তার ক্ষতিসাধনে নেমেছিল।
“আর আল্লাহর ওপরই মুমিনদের ভরসা করা উচিত।”
সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ১১
“অতঃপর তুমি যখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তখন আল্লাহর ওপর ভরসা কর।”
সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯
“আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্যে যথেষ্ট।”
সূরা আত-তালাক, আয়াত: ৩
“মুমিন তো তারা, যাদের অন্তরসমূহ কেঁপে উঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আর যখন তাদের ওপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং যারা তাদের রবের ওপরই ভরসা করে।”
সূরা আল আনফাল, আয়াত: ২
বহু মানুষকে বলতে শুনি – সে যুদ্ধের অপেক্ষায় আছে, যুদ্ধ শুরু হলে সে জেহাদ করে শহীদ হবে!! অথচ আশেপাশে কত জুলুম, অন্যায় চলছে নূন্যতম দাওয়াত ও প্রতিবাদ করে না ভয়ে। তাহলে আপনি ভবিষ্যতে কিভাবে জেহাদ করবেন? রসুল (সাঃ) ও সাহাবীদের জীবনী দেখুন- মক্কার প্রাথমিক জীবনে যারা ঈমান আনেন।
● হাদীসে বর্নিত- শয়তান বনী আদমের তিন স্থানে বসে পড়ে তাকে এগোতে দেয় না। সে তার ইসলাম গ্রহণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সে বলতে থাকে তুমি কি তোমার পিতা-পিতৃপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করবে? তারপর বনী আদম তার বিরোধিতা করে ইসলাম গ্রহণ করে, তখন সে তার হিজরতের পথে বাঁধ সাধে। সে বলতে থাকে, তুমি কি তোমার সম্পদ ও পরিবার-পরিজন ত্যাগ করবে? তারপর বনী আদম তার বিরোধিতা করে হিজরত করে, তখন সে তার জিহাদের পথে বাঁধ সাধে। সে বলতে থাকে, তুমি কি জিহাদ করবে এবং নিহত হবে? তখন তোমার স্ত্রীর অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাবে, তোমার সম্পদ ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যাবে, তারপর বনী আদম তার বিরোধিতা করে জিহাদ করে। এমতাবস্থায় তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো আল্লাহর হক হয়ে যায়। [নাসায়ী: ৩১৩৪]
কোন অজুহাতে আপনি সত্য গ্রহণে বা প্রচারে বিরত আছেন তা শয়তানের ওয়াসওয়াসা নয় তো!? তাওহীদের দাওয়াত দেওয়ায় – অসহায় রসুল (সাঃ) ও সাহাবিদের উপর আঘাত, অত্যাচার, অবরোধ এসেছিল তবুও তারা সত্যের দাওয়াত চালিয়ে গেছেন – তাই জেহাদ আসলেও তারা ঠিকই ঈমানের পথে দৃঢ় ছিলেন।।
অথচ উবাই ইবনে সলুলের মত মুনাফেকরা যারা মদীনায় দুনিয়ার পদ, লোভের আশায় ঈমানদার হওয়ার ভান করেছেন তারা জেহাদের ময়দান হতে মিথ্যা অজুহাতে পালিয়েছে।