কুরআনে রূহ বলতে জিব্রাঈল (আঃ) ও আত্মাকে বুঝানো হয়েছে। আমাদের আলোচনার বিষয় হল রূহ বা আত্মা।
রূহ এমন অশরীরী বস্তু, যা কারো দৃষ্টিগোচর হয় না। কিন্তু প্রত্যেক প্রাণীর শক্তি ও সামর্থ্য এই রূহের মধ্যেই লুক্কায়িত। এর প্রকৃত স্বরূপ কেউ জানে না। মূলত রূহ বা আত্মার প্রকৃত জ্ঞান আল্লাহর নিকট। তিনি যতটুকু জানান মানুষের এরচেয়ে বেশি জানা সম্ভব না। বনী ইসরায়েল জাতি আজও রূহের নামে যাদের আহ্বান করে বা সম্মুখে আনে তা মূলত শয়তান জ্বিন। যা দাজ্জালের যুগে প্রকাশ্যে হবে।
● আবু উমামা থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসে নবী করীম সা. বলেন, “দাজ্জাল বেদুইনের কাছে এসে বলবে- “ওহে বেদুইন! আমি যদি তোমার মৃত পিতা-মাতাকে জীবিত করে দিই, তবে আমাকে প্রভু বলে মেনে নিতে তোমার কোন আপত্তি থাকবে? বেদুইন বলবে- না!! অতঃপর দু-জন শয়তান তার পিতা-মাতার রূপ ধরে তাকে বলবে- ওহে বৎস! একে অনুসরণ কর! সে তোমার প্রভু!!” (মুস্তাদরাকে হাকিম)। তার মানে শয়তান মৃত ব্যক্তির ছদ্মবেশ ধরতে পারে। ছদ্মবেশে এমন কথা ধর্মের নাম প্রচার করে যা শিরক ও কুফর। তাই কোন পীরের আত্মা বা স্বজনের আত্মার বেশে এসে এমন কোন কথা যদি কেউ প্রচার করে যা কুরআন-সুন্নাহর বিপরীত তা শয়তানের প্রচারনা। এছাড়া শয়তানরা উট, বিড়ালসহ অন্য মৃত প্রানীর ছদ্মবেশ ধরতে পারে।
● হযরত আসমা বিনতে ইয়াযীদ (রাঃ) বর্ণনা করেন, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার ঘরে অবস্থানরত ছিলেন। তখন তিনি দাজ্জাল সম্পর্কে কিছু কথা বললেন। তিনি বলেছেন, তার ফেতনাসমূহের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ফেতনাটি এই হবে যে, সে এক গ্রাম্য লোকের নিকট আসবে এবং বলবে, তোমার খেয়াল কি; আমি যদি তোমার মৃত উটটি জীবিত করে দেই তাহলে কি তুমি মেনে নিবে আমি তোমার রব? গ্রাম্য লোকটি বলবে, হ্যা। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তারপর শয়তানরা তার মৃত উটটিকে ঠিক আগের মত বরং তার চেয়েও উত্তম- যেমন দুগ্ধদায়িনী ভরাপেট ছিল বানিয়ে দিবে।
অনুরূপভাবে দাজ্জাল এমন এক ব্যক্তির নিকট আসবে যার পিতা ভাই মারা গেছে। তাকে বলবে, তোমার ধারণা কি; আমি যদি তোমার বাপ ও ভাইকে জীবিত করে দেই তাহলে কি তুমি মেনে নিবে আমি তোমার রব? উত্তরে সে বলবে, কেন নয়? ফলে তারপর শয়তানরা লোকটির পিতা ভাইয়ের আকৃতিতে এসে হাজির হবে। [আল ফিতান, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৩৫]
তাই গভীর রাতে এরকম কিছু বা মৃত মানুষকে দেখলে আত্মা ভেবে ভয় না পেয়ে শয়তানের ফেতনা হতে আল্লাহর কাছে ফানাহ চান। যে মানুষ মারা যায়, দেহত্যাগ করে বারযাখী বা কবর জগতে চলে যায়, সে আর ইহজগতে ফিরে আসে না, কেউ তাকে আনতে বা হাজির করতে পারে না। মরণের পর কয়েক দিন বাড়িতে আসা-যাওয়া করে এমন কোন দলিল নেই। রূহ’ একটি গায়বী বস্তু। তার প্রকৃতত্ব মানুষের জ্ঞান-বহির্ভূত। মহান আল্লাহ বলেছেন,
“তোমাকে তারা আত্মা সম্পর্কে প্রশ্ন করে। তুমি বল, ‘আত্মা আমার প্রতিপালকের আদেশ বিশেষ; আর তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে।”
সূরা বানী ইসরাঈল-১৭:৮৫
বনী ইসরায়েল পন্ডিতরা রূহ সম্পর্কে জানতে চাইলে তার পরিপ্রেক্ষিতে তা নাযিল হয়। মহান আল্লাহ মানুষের মৃত্যু ঘটান এবং তিনিই রূহসমূহকে আটকে রাখেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
‘আল্লাহ জীবসমূহের প্রাণ হরণ করেন তাদের মৃত্যুর সময় এবং যারা মরেনি তাদের নিদ্রার সময়। তারপর যার জন্য তিনি মৃত্যুর ফয়সালা করেন তার প্রাণ তিনি রেখে দেন এবং অন্যগুলো ফিরিয়ে দেন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল জাতির জন্য অনেক নিদর্শন আছে।’
সুরা জুমার, আয়াত: ৪১
অতঃপর ফিরিশতার মাধ্যমে তিনি অপরাধী রূহকে আযাব ও অনুগত রূহকে শান্তি দিতে থাকেন। ও (অপরাধী রূহ) থাকে সিজ্জীনে, এ (অনুগত রূহ) থাকে ইল্লিয়্যীনে। নেক রূহসমূহ থাকে তাদের প্রতিপালকের নিকটে। মহান আল্লাহ বলেছেন,
“যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদেরকে কখনই মৃত মনে করো না, বরং তারা তাদের প্রতিপালকের নিকট জীবিত; তারা জীবিকা-প্রাপ্ত হয়ে থাকে।”
সূরা আলে ইমরান-৩:১৬৯
আর সে জীবন তাদের বিশেষ জীবন, এ জীবন থেকে তা অনুভূতির বাইরে। মহান আল্লাহ বলেছেন,
“যারা আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করে, তাদেরকে মৃত বল না, বরং তারা জীবিত; কিন্তু তা তোমরা উপলব্ধি করতে পার না। “
সূরা আল বাক্বারাহ-২:১৫৪
● “তাদের (শহীদদের) আত্মাসমূহ সবুজ পক্ষীকুলের দেহ মধ্যে অবস্থান করে। ঐ পক্ষীকুলের অবস্থান ক্ষেত্র হল (আল্লাহর) আরশে ঝুলন্ত দীপাবলী। তারা জান্নাতে যেখানে ইচ্ছা বিচরণ করে বেড়ায়। অতঃপর পুনরায় ঐ দীপাবলীতে ফিরে এসে আশ্রয় নেয়। (মুসলিম মাশা. হা/৪৯৯৩)।
জান্নাতে ইচ্ছামত পরিভ্রমণ করে বেড়ায়। আওলিয়া ও সালেহীনদের রূহও পাখীর বেশে জান্নাতের গাছে গাছে অবস্থান করে। (মুসনাদে আহমাদ মাশা হা/৩/৪৫৫, ইবনে মাজাহ তাও, হা/১৪৪৯)।
এ দুনিয়ায় কোন রূহের ফিরে আসা যে অসম্ভব, সে ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেছেন,
“অর্থাৎ, যখন তাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন সে বলে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে পুনরায় (দুনিয়ায়) প্রেরণ কর। যাতে আমি আমার ছেড়ে আসা জীবনে সৎকর্ম করতে পারি।’ না এটা হবার নয়; এটা তো তার একটা উক্তি মাত্র; তাদের সামনে বারযাখ (যবনিকা) থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত।”
সুরা মু’মিনূন-২৩: ৯৯-১০০
সুতরাং সেই জগৎ থেকে এ জগতে কোন রূহ উপস্থিত করা কীভাবে সম্ভব হতে পারে। যারা দাবী করে তারা আওলিয়া বা অন্য বা মন্দ লোকের রূহ হাজির করে, তাহলে অনেক সময় তথাকথিত উপস্থিত রূহ যে কথা বলে, তা সত্য হয় কীভাবে? যদি সত্য হয়, তাহলে তা অনুমানে দু-একটা লেগে যাওয়া সত্য। নচেৎ তা শয়তান জ্বিনের মাধ্যমে অথবা উক্ত রূহের ‘ক্বারীন’ (আজীবন সঙ্গী) জিন দ্বারা বলানো হয়।
অনেক ‘জ্বিন-বাবা’ অথবা ‘জ্বিন-বিবি’ রূহ হাজির করার নামে বাতিল উপায়ে মানুষের অর্থ-সম্পদ লুটে খাচ্ছে। আল্লাহই তাদের হিদায়াতের মালিক। অনেকে রসুল (সাঃ) এর মেরাজের ঘটনা ও ঈসা (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে মৃতকে জীবিত করার ঘটনাকে তুলে ধরে প্রমান করতে চায় – রুহকে ডেকে আনা সম্ভব।
প্রথমমত – তা রসুলদের বিশেষ মোজেজা, আল্লাহ জানিয়েছেন। কুরআন-হাদীসে আমরা বিশ্বাস করি। এরূপ ক্ষমতা সাহাবীদের ছিল না। কিন্তু ওদের দাবির পিছনে কি কোন সত্যি দলিল আছে?
দ্বিতীয়ত – মেরাজে রসুল (সাঃ) দুনিয়ার জীবনে জীবিত ছিল আর বাকী নবীরা বারযাখী জীবনে।
তাই রসুল (সাঃ) যে নবীদের সালাত পড়িয়েছিলেন জেরুজালেমে তাদের অনেককে (আদম, ইব্রাহিম, মুসা (আঃ)) তিনি আসমানে পেয়েছিলেন যারা তার পূর্বে পোছেছিল। আর ঈসা (আঃ) সময় যে মৃতরা জীবিত হতো তা ঈসা (আঃ)-এর নবুওয়তের মেজেজা স্বরূপ এর কিছুক্ষণ পর আবার তাদের মৃত্যু হতো। এমন কোন দলিল নেই – তারা দুনিয়ার জীবনের মত জীবিত হয়ে ঘুরে বেড়াত। বারযাখী জীবনের জ্ঞান সম্পূর্ণ আল্লাহর কাছে। এই নিয়ে বাড়াবাড়ি করা সীমালঙ্ঘন।
স্বপ্নে মৃত ব্যক্তিকে দেখা যায় তা শয়তানের তরফ থেকে হতে পারে আল্লাহর তরফ থেকেও হতে পারে।
● রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাকে স্বপ্নে দেখল, সে আমাকেই দেখল। কেননা বিতাড়িত শয়তান আমার রূপ ধরতে পারে না। আর যে ব্যক্তি আমার ওপর মিথ্যাচার করল, সে তার দোজখের আসন গ্রহণ করল।’ –(সহিহ বোখারি : ১১০)।
তার মানে রসুল (সাঃ) ছাড়া শয়তান অন্য কারো রূপে আসতে পারে। আর স্বপ্নে কোন নতুন আমল বা বিধান আসবে না কারণ দ্বীন পূর্নাঙ্গ হয়েছে বরং কোন শরীয়াসম্মত আমল করার জন্য তাগিদ দিবে। যেমন- স্বপ্নে কখনো নতুন সালাত, জিকির বা দরূদ আসবে না যা রসুল (সাঃ) ও সাহাবীরা করেননি। যদি এরকম কেউ দাবি করে তা শয়তানের ফেতনা। কারণ রসুলের (সঃ) চেয়ে উত্তম আমলকারী কেউ হতে পারে না!? তিনি ও সাহাবীরা আমল করে দেখিয়ে গেছেন। স্বপ্নে এমন দেখাতে পারে – হয়তো কোন ব্যক্তি তাহাজ্জুদ সালাত পড়ে না তাকে পড়ার জন্য নির্দেশ বা উৎসাহ দিবে।
কোন পীর, বুজুর্গ বা মৃত পিতামাতাকে যদি স্বপ্নে দেখেন যারা এমন কিছু বলছে যা শরীয়তের বিপরীত তাহলে তা শয়তানের ফেতনা। যেমন- স্বপ্নে যদি দেখেন পিতামাতার আত্মার শান্তির জন্য শিরকী মাজারে অর্থ বা গরু দান করতে বলে তা শয়তানের ফেতনা। পিতামাতার আত্মার শান্তির জন্য কোথায় কোথায় দান সদকা করতে হবে হাদীসে বর্ণিত আছে।
এখন কিভাবে বুঝবেন কোন ব্যক্তি সত্যিই রসুলকে (সাঃ) স্বপ্নে দেখেছে?
ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায় যে, অনেক সাহাবি, তাবেঈ ও বুজুর্গরা নবী করিম (সা.) কে স্বপ্নে দেখেছেন। ইসলামের বিধান হলো, নবী করিম (সা.) কে স্বপ্নে দেখা বাস্তবে দেখার মতো। কেননা, শয়তান কখনও নবীজির আকৃতি ধারণ করতে পারে না।
এখন আমাদের জানা দরকার, নবী করিম (সা.) কেমন ছিলেন। কোন আকৃতিতে তাকে স্বপ্নে দেখা যাবে। শামায়েলে তিরমিজির বর্ণনায় নবী করিম (সা.)-এর আকার-আকৃতির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে—
তিনি ছিলেন মানানসই দীর্ঘদেহী। তার গায়ের রঙ দুধে-আলতায় মিশ্রিত গোলাপের মতো। গোলগাল হালকা-পাতলা চেহারা। ঘন দাড়ি। মুখগহবর প্রশস্ত। ঘাড় যেন রৌপ্যপাত্রে রক্তঢালা। কেশরাশি সামান্য কোঁকড়ানো-বাবরি। মেদহীন সুঠাম দেহ। হাত-পায়ের আঙুলগুলো শক্তিশালী ও মজবুত।
বাহু, কাঁধ ও বুকের ওপরে পশমবিশিষ্ট। অতিরিক্ত পশমমুক্ত শরীর। বুকে নাভি পর্যন্ত পশমের দীর্ঘ রেখা। দুই কাঁধের মাঝখানে মোহরে নবুওয়ত। মাথা ও অস্থিবন্ধনীগুলো কিছুটা বড়সড়। প্রশস্ত ললাট। চক্ষুগোলক ডাগর ডাগর। চোখের মণি কুচকুচে কালো। পাপড়ি লম্বাটে। ভ্রুযুগল অমিলিত প্রশস্ত ঘন।
ভ্রুদ্বয়ের মাঝখানে প্রস্ফুটিত একটা রগ, যা রাগের সময় স্ফীত হতো। উন্নত চকচকে নাসিকা। দাঁতগুলো বিযুক্ত রূপার গাথুনি। এক কথায় তার অপূর্ব রূপমাধুর্য বর্ণনাতীত। যে কেউ তাকে প্রথম দর্শনে হতভম্ব হয়ে পড়ত। সে একথা বলতে বাধ্য- জীবনে এমন সুন্দর মানুষ দ্বিতীয়জন দেখিনি।’
নবী করিম (সা.) কে স্বপ্নে দেখতে হবে ঈমান অবস্থায়। পূর্ণ ইসলাম পরিপালনকারী ও সুন্নতের অনুসারীরাই কেবল তাকে দেখতে পাবেন। এ ছাড়া কেউ নবী করিম (সা.) কে দেখার দাবী করলে সেটা মিথ্যা দাবী হবে।