জিন ও শয়তান পর্ব-২ (শয়তানের প্রকারভেদ)

ক্বারিন (সঙ্গী)

● বর্ণনায় হযরত আয়িশা (রাঃ), একরাতে জনাব রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আমার কাছ থেকে উঠে বাইরে চলে গেলেন। আমার চিন্তা হল (যে, হয়তো তিনি অন্য কোনও স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন)। তিনি ফিরে এসে আমাকে (জাগ্রত ও চিন্তিত অবস্থায়) দেখে বললেন- তোমাকে তোমার শয়তান ওয়াসওয়াসায়) ফেলেছে। আমি নিবেদন করলাম- ‘আমার সাথেও শয়তান আছে?’ তিনি বললেন-‘হ্যাঁ, শয়তান তো সকল মানুষের সাথে থাকে। আমি নিবেদন করলাম- হে আল্লাহর রসূল! আপনার সঙ্গেও আছে কি?’ তিনি বলেন -‘হ্যাঁ, কিন্তু আমার পালনকর্তা আমাকে সহায়তা করেছেন, অবশেষে সে মুসলমান হয়ে গেছে।

● হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
‘তোমাদের মধ্যে এমন কোনও ব্যক্তি নেই যার সাথে জ্বিনদের মধ্য থেকে একজন সাথী ও ফিরিশতাদের মধ্য থেকে একজন সাথী নিযুক্ত করা হয় না।’ সাহাবীগণ বললেন- হে আল্লাহর রসূল! আপনার সাথেও আছে কি?’ তিনি বললেন-‘হ্যাঁ, আমার সাথেও, কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা তার বিরুদ্ধে আমাকে সাহায্য করেছেন এবং সে মুসলমান হয়ে গেছে। এখন সে সৎকাজ ছাড়া অন্য কিছুর কথা আমাকে বলে না। (মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)

● হযরত হবনে উমর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:
আদমের চেয়ে আমাকে এই দু’টি শ্রেষ্ঠত্বও দান করা হয়েছে- (১) আমার শয়তান কাফির ছিল, আল্লাহ তা’আলা তার বিরুদ্ধে আমাকে মদদ করেছে। শেষ পর্যন্ত সে মুসলমান হয়ে গেছে এবং (২) আমার পত্নীগণ আমার সহায়তাকারিণী থেকেছে। অপরদিকে (৩) আদমের শয়তান ছিল কাফির এবং (৪) তাঁর স্ত্রী ছিল তাঁর পদস্থলনের অংশীদার। (ইবনে হিব্বান ২১০১, তবারানী)

এই হাদীসগুলো রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর করীন (সঙ্গী শয়তান)-এর ইসলাম কবুলের সুস্পষ্ট প্রমাণ। এবং এটি নবীজীরই বৈশিষ্ট্য। উল্লেখিত হাদীসের একটি অর্থ এটাও যে, আল্লাহ তা’আলা ‘নবীজীকে সাহায্য করেছেন এমনকি তিনি সঙ্গী-শয়তানের অনিষ্ট থেকে সুরক্ষিত থাকতেন।

● হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ
মানুষের সাথে শয়তানদের সম্পর্ক থাকে, ফিরিশ্তাদেরও সম্পর্ক থাকে। শয়তানদের সম্পর্ক হল মন্দের দিকে প্ররোচিত করা ও সত্যকে মিথ্যা বানানো। এবং ফিরিশ্তাদের সম্পর্ক হল সৎকাজের প্রতি প্রেরণা দেওয়া এবং সত্যকে স্বীকার করা।
সুতরাং যে ব্যক্তি এটা বুঝতে পারবে (যে, সে ফিরিশতার দ্বারা উপকৃত হচ্ছে), তাহলে তার উচিত এটাকে আল্লাহর বিশেষ দান মনে করা এবং এজন্য আল্লাহর গুণগান করা। আর যে ব্যক্তির অবস্থা এর বিপরীত হবে, সে যেন শয়তানের (অনিষ্ট) থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে। অতঃপর নবীজী (কোরআন পাকের এই আয়াতটি) …..”শয়তান তোমাদেরকে দরিদ্রতার ভয় দেখায় এবং অশ্লীল কাজের আদেশ করে। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তার পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্য্যময়, সর্বজ্ঞ।” (তিরমিজি ২৯৯৮, তাফসিরে ইবনে কাসির)

তাই যখন দারিদ্র্যতার ভয় আসবে বিশ্বাস রাখতে হবে আল্লাহ প্রাচুর্য্যময় আর যখনই অশ্লীলতার আশংকা জাগবে স্মরণ করবেন আল্লাহ সবকিছু দেখেন ও জানেন।

ওলহান ও খিনজির

● হযরত উবাই বিন কাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, জনাব রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ

إن الوضوء شيطانا يقال له ، الولهان ، فا تقوا وسواس الماء

অযূরও এক শয়তান আছে, যার নাম ‘অল্হান’। সুতরাং তোমরা পানির অপচয় থেকে বেচে থাকো। এরকম করলে শয়তান পালাবে)।

‘খিনজির/খানজাব’ – বিশেষ একপ্রকার জিন, যারা মানুষ যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন তাদেরকে নানান রকম চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দেয়, লোকদেরকে সালাত থেকে অমনোযোগী ও উদাসীন করে তোলে। এর ফলে তারা সালাতে ভুল করে, কত রাকাত পড়েছে মনে থাকেনা, কোনটা কি করছে সন্দেহে পড়ে যায়, সুরা-ক্বিরাতে উল্টা-পাল্টা করে। একারণে তাদের সালাতে সওয়াবও কমে যায়। তাই আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে যথাযথ খুশু (ভয়) ও খুজু (বিনয়, স্থিরতা) সহকারে মনোযোগী হয়ে সালাত আদায় করার জন্য।

● রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “সালাতের জন্য যখন আযান দেওয়া হয় তখন শয়তান সশব্দে বায়ু ছাড়তে ছাড়তে পলায়ন করে, যেন সে আযানের শব্দ না শুনতে পারে, আযান শেষ হলে সে আবার লোকালয়ে ফিরে আসে। (সালাতের জন্য মসজিদে) ইকামত আরম্ভ হলে (শয়তান) আবার পলায়ন করে। ইকামত বলা শেষ হলে পুনরায় উপস্থিত হয় এবং ওয়াসওয়াসা ঢেলে দিয়ে সালাত আদায়রত ব্যক্তি ও তার অভীষ্ট লক্ষ্যের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। যে সকল বিষয় তার স্বরণ ছিল না, সেই সব জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট করে সে বলতে থাকেঃ অমুক বিষয় স্বরণ কর, অমুক বিষয় স্বরণ কর। ফলে সেই ব্যাক্তি কত রাকাত সালাত পড়েছে, এমনকি সেটাও ভুলে যায়।” (মুয়াত্তা মালিকঃ সালাত অধ্যায় ৩, হাদিসঃ ১৫২)।

শক্তিশালী ইফরিত

“সুলায়মান বললেন, হে পরিষদবর্গ, তারা আত্নসমর্পণ করে আমার কাছে আসার পূর্বে কে বিলকীসের সিংহাসন আমাকে এনে দেবে? জনৈক ইফরিত-জিন বলল, আপনি আপনার স্থান থেকে উঠার পূর্বে আমি তা এনে দেব এবং আমি একাজে শক্তিবান, বিশ্বস্ত।” (সুরা নামল ৩৮-৩৯)

সুলায়মান (আঃ) জেরুজালেম হতে শাসন করতেন অপরদিকে রানী বিলকীসের সিংহাসন ছিল ইয়েমেনের সাবায় যা বর্তমানে মারিব নামে পরিচিত। কয়েকশো মাইলের দূরত্ব স্বত্বেও দ্রুত সিংহাসন এনে দেওয়ার কথা প্রমান করে ইফরিত জ্বিন দ্রুতগতি সম্পন্ন ও শক্তিশালী। অনেক আলেমদের অভিমত- তারা কোন বস্তুকে চোখের আড়াল করে অন্যখানে নিয়ে যেতে পারে এজন্য জাদুকররা জাদুর জন্য ওদের সাহায্য নেয়।

● রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “গতকাল রাতে আমার সালাত নষ্ট করার জন্য জ্বিনদের মধ্য হতে এক ‘ইফরীত’ (জিন) থু থু নিক্ষেপ করেছিল। তবে আল্লাহ তাআ’লা তার উপরে বিজয়ী হতে আমাকে সাহায্য করেছেন। সকালে তোমাদের সবাইকে দেখানোর জন্য আমি তাকে মসজিদের একটি খুঁটির সাথে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলাম। তারপর আমার ভাই সুলায়মানের দুয়ার কথা আমার মনে পড়ল। (আমার ভাই সুলায়মান আল্লাহর কাছে এই বলে দুয়া করেছিলেন), “হে আমার মালিক, (আমি যদি কোনো ভুল করি তাহলে) তুমি আমাকে ক্ষমা করো, তুমি আমাকে এমন এক সাম্রাজ্য দান করো, যা আমার পরে আর কেউ কোনোদিন পাবে না, তুমি নিশ্চয়ই মহানদাতা।”( সুরা সোয়াদঃ ৩৫।)” সহীহ বুখারীঃ ৭৫, সহীহ মুসলিমঃ ১১০৪।

ডুবুরি ও কারুকার্য শিল্পে দক্ষতা

আল্লাহ বলেন- “আর সকল শয়তানকে তার অধীন করে দিলাম, যারা ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী’। ‘এবং অন্য আরও অনেককে অধীন করে দিলাম, যারা আবদ্ধ থাকত শৃংখলে’” (ছোয়াদ ৩৮/৩৭-৩৮)।
আরও উল্লেখ রয়েছে –
“তারা সুলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাষ্কর্য, হাউযসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লীর উপরে স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত…” (সাবা ৩৪/১৩)।
সুলায়মান (আঃ) এর নিকট অনেক বিজ্ঞ মানুষ থাকা স্বত্বেও তিনি জ্বিন দ্বারা দুর্গ, অট্টালিকা নির্মাণ করতো এবং ওরা ডুবুরির কাজ করত।
আল্লাহ বলেন-
“তাকে বলা হ’ল, প্রাসাদে প্রবেশ করুন। অতঃপর যখন সে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করল, তখন ধারণা করল যে, এটা স্বচ্ছ গভীর জলাশয়। ফলে সে তার পায়ের গোছা খুলে ফেলল। সুলায়মান বলল, এটা তো স্বচ্ছ স্ফটিক নির্মিত প্রাসাদ। বিলক্বীস বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমি তো নিজের প্রতি যুলুম করেছি। আমি সুলায়মানের সাথে বিশ্বজাহানের পালনকর্তা আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করলাম” (সুরা নামল)।

তার মানে বুঝা যায় নির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের জ্ঞান উন্নত ও ওরা পানিতে অনেকক্ষণ থাকতে পারে।

তাই অনেকে মনে করেন – পিরামিডসহ অন্যান্য স্হাপনায় জ্বিনদের ভূমিকা রয়েছে। আর সাগরের নিচে গুপ্ত সম্পদের সন্ধান শয়তান জ্বিনেরা তার অনুসারীদের দিয়ে থাকে ফেতনা সৃষ্টি করার জন্য।

জিন ও শয়তান সিরিজের সকল পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *