আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে – অমুক খোনার বা হুজুর জিন হাজির করতে পারেন ও জিন দ্বারা বিভিন্ন তথ্য জেনে নেন। আবার অনেকে দাবি করেন জিনকে বোতলে বন্দী করে রাখেন। অথচ হাদীসে বর্নিত আছে –
হজরত আবু দারদা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক রাতে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজ আদায় করতে দাঁড়ালে হঠাৎ তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘আউজুবিল্লাহি মিনকা, অর্থাৎ আমি তোমার থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ এরপর তিনি বললেন, ‘আল-আনুকা বি লানাতাল্লাহি অর্থাৎ আমি তাকে লানত করছি, যেমন আল্লাহ লানত করেছিলেন।’ তিনি এ কথাগুলো তিনবার বললেন। এ সময় তিনি হাত বাড়ালেন যেন কিছু ধরতে যাচ্ছেন।
সাহাবি হজরত আবু দারদা (রা.) এ অবস্থা বর্ণনা করে বলেন, নামাজ শেষ করলে আমরা নবী কারিম (সা.)-কে বললাম, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমরা নামাজের মধ্যে আপনাকে এমনকিছু কথা বলতে শুনেছি, যা ইতিপূর্বে আর কোনো সময় বলতে শুনিনি। আর আমরা দেখলাম, আপনি হাতও বাড়ালেন! হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) উত্তর দিলেন, আল্লাহর শত্রু ইবলিস (শয়তান) আমার মুখের ওপর নিক্ষেপ করার জন্য দগদগে অগ্নিশিখা নিয়ে এসেছিল। তাই আমি তিনবার বললাম, ‘আউজুবিল্লাহি মিনকা।’ এরপর ‘আল-আনুকা বি লানাতাল্লাহি’ কথাটি তিনবার বললাম। তবু সে পিছু হটলো না।
অবশেষে আমি তাকে ধরার ইচ্ছা করলাম। আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমাদের ভাই নবী সোলায়মান (আ.) যদি দোয়া না করে থাকতেন, তাহলে সে সকাল পর্যন্ত বাঁধা থাকতো। আর সকালবেলা মদিনাবাসীদের শিশুরা তাকে নিয়ে খেলা করতো।’ (সহিহ মুসলিম: ১০৯৮)
সকালবেলা হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘটনাটি সবাইকে জানিয়ে বললেন, গত রাতে এক দুষ্টু জিন (শয়তান) আমার নামাজ নষ্ট করার জন্য আমার ওপর আক্রমণ করতে শুরু করল। তবে আল্লাহতায়ালা আমাকে তাকে কাবু করার শক্তি দান করলেন। আমি তাকে গলা টিপে ধরেছিলাম। আমার ইচ্ছে হলো, তাকে মসজিদের একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখি যাতে সকালবেলা তোমরা সবাই তাকে দেখতে পাও। কিন্তু তখনই আমার স্মরণ হলো, আমার ভাই নবী সোলায়মান (আ.)-এর দোয়ার কথা।
তিনি দোয়া করেছিলেন,
‘হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমাকে দান করুন এমন এক রাজ্য, যা আমার পরে আর কারও জন্য প্রযোজ্য হবে না।’
সুরা সোয়াদ : ৩৫
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন,
“আর জিনের মধ্যে কিছুসংখ্যক তার (সুলায়মানের) সম্মুখে কাজ করত তার পালনকর্তার (আল্লাহর) আদেশে…”
সূরা সাবা, আয়াত-১২
অন্যত্র মহান আল্লাহ পাক বলেন,
‘এবং আমি তার অধীন করে দিয়েছিলাম শয়তানদের কতককে, যারা তার জন্য ডুবুরীর কাজ করত এবং এছাড়া অন্য আরো কাজ করত। আমি তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতাম।’
সূরা আম্বিয়া, আয়াত-৮২
পবিত্র কোরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে,
‘আর সকল শয়তানকে তার অধীন করে দিলাম, যারা ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী’। ‘এবং অন্য আরো অনেককে অধীন করে দিলাম, যারা আবদ্ধ থাকত শৃংখলে।’
সূরা ছোয়াদ, আয়াত ৩৭-৩৮
একমাত্র সোলেমান (আঃ) কে দুষ্ট জ্বিনদের বন্দী করে রাখার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল আর জ্বিনরা তার সেনাবাহিনীর অংশ ছিলো। তারা গায়েব জানতো না।
কুরআনে বর্নিত আছে-
‘অতঃপর যখন আমরা সুলায়মানের মৃত্যু ঘটালাম, তখন ঘুনপোকাই জিনদেরকে তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করল। সুলায়মানের লাঠি খেয়ে যাচ্ছিল। অতঃপর যখন তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তখন জিনেরা বুঝতে পারল যে, যদি তারা অদৃশ্য বিষয় জানতো, তাহ’লে তারা (মসজিদ নির্মাণের) এই হাড়ভাঙ্গা খাটুনির আযাবের মধ্যে আবদ্ধ থাকতো না’
সূরা সাবা, আয়াত ১৪
অপরদিকে রসুলল্লাহ’(সাঃ)-এর মর্যাদা এমন ছিল তার ক্বারিনসহ অনেক জ্বিনই তার উপর ঈমান এনে মুসলিম হয়েছিল। আর সুরা ফালাক, সুরা নাস, আয়াতুল কুরসীসহ কুরআনের আয়াত এই উম্মতের সুরক্ষাকবজ।
নবীজি জিনদের যেভাবে দাওয়াত দিয়েছেন
জিন জাতি আল্লাহর বিস্ময়কর ও রহস্যঘেরা সৃষ্টি। কোরআনের শতাধিক আয়াতে জিন শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। মানুষের মতো তারাও আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের জন্য আদিষ্ট। যেমন ইরশাদ হয়েছে,
‘আমি মানুষ ও জিন জাতিকে কেবল আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’
সুরা : জুররিয়্যাত, আয়াত : ৫৬
মানবজাতির মতো তাদের ভেতরও আল্লাহ নবী ও রাসুল প্রেরণ করেছেন।
আল্লাহ বলেন,
‘হে জিন ও মানব সম্প্রদায়! তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে রাসুল আসেনি, যারা তোমাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ বর্ণনা করেছে।’
সুরা : আনআম, আয়াত : ১৩০
কোরআনের বর্ণনায় জিন জাতির ইসলাম গ্রহণ
রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও জিনদের মধ্যে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। কোরআন ও হাদিসের একাধিক বর্ণনা থেকে জিনদের সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর সাক্ষাৎ প্রমাণিত হয়। হাদিসের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, রাসুল (সা.) জিন জাতির কাছে একাধিকবার দ্বিনের দাওয়াত নিয়ে যান এবং তাঁর হাতে জিনদের এক ও একাধিক দল ইসলামও গ্রহণ করে। পবিত্র কোরআনে ‘জিন’ নামে একটি স্বতন্ত্র সুরা রয়েছে।
কুরআনে বর্নিত আছে-
‘বলুন! আমার প্রতি ওহি অবতীর্ণ হয়েছে, জিনদের একটি দল মনোযোগ দিয়ে (কোরআন) শ্রবণ করেছে এবং বলেছে, আমরা এক বিস্ময়কর কোরআন শ্রবণ করেছি, যা সঠিক পথের নির্দেশ করে। ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা আমাদের প্রতিপালকের সঙ্গে কাউকে শরিক করব না।’
সুরা: জিন, আয়াত : ১-২
আজও জ্বিনেরা দ্বীন জানার জন্য আলেমদের কাছে আসতে পারে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু জ্বিনরা গায়েব জানে না, আর শয়তান জ্বিনরা সত্যের সাথে মিথ্যা মিশ্রণ করে।
কিভাবে বুঝবেন সে সত্যি বলছে না মিথ্যা। সোলেমান (আঃ) জ্বিনদের বন্দী করে। শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা স্বত্বেও তিনি হুদহুদ পাখিকে বার্তাবাহক ব্যবহার করেছেন।
রসুলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবীরা জ্বিনদের হাজির করে বার্তা নিতেন না বরং ওহী নিয়ে মালাইকা (ফেরেশতা) আসতো আর দ্বীন শেখার জন্য জ্বিনরা আসতো।
কিভাবে বুঝবেন খোনার বা হুজুর যে জ্বিন উপস্থিত করেছে তা মুসলিম না শয়তান
জ্বিন উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথে আযান, আয়াতুল কুরসী, সুরা ফালাক ও নাস, সুরা বাকারাহ পড়ুন দেখবেন শয়তান জ্বিন পালিয়ে যাবে আর মুসলিম জ্বিন কুরআন শুনবে মনযোগ দিয়ে।
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘তোমরা নিজেদের ঘর-বাড়িগুলো কবরে পরিণত কর না। যে বাড়িতে সূরা বাক্বারাহ পাঠ করা হয়, অবশ্যই সে বাড়ি থেকে শয়তান পলায়ন করে’। [মুসলিম]
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমাকে রাসূলুল্লাহ (সা) যাকাতুল ফিতর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিলেন। আমি তিন রাত চোর আটক করলাম।
বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সে ২ রাতে ছুটে গেল। তৃতীয় রাতে সে বলল, আমাকে ছেড়ে দাও তোমাকে কিছু বাক্য শিখিয়ে দিব, যা দ্বারা তোমার উপকার হবে। আমি বললাম, সেগুলো কি? সে বলল, যখন তুমি ঘুমাতে যাবে তখন ‘আয়াতুল কুরসী’ পাঠ করবে। তাহ’লে তোমার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রক্ষক নিযুক্ত করা হয়। আর সকাল পর্যন্ত তার নিকট শয়তান আসতে পারে না।
ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট বর্ণনা করার পর তিনি বললেন, হে আবু হুরায়রা। তুমি কি জান সে কে? সে হ’ল চিরমিথ্যাবাদী কিন্তু তোমার সাথে সত্য বলেছে। সে হ’ল শয়তান’। [বুখারী]
হাদীসে উল্লেখ রয়েছে –
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ্র রসূল (সঃ) বলেছেনঃ যখন সালাতের জন্য আযান দেয়া হয়, তখন শয়তান হাওয়া ছেড়ে পলায়ন করে, যাতে সে আযানের শব্দ না শুনে। যখন আযান শেষ হয়ে যায়, তখন সে আবার ফিরে আসে। আবার যখন সালাতের জন্য ইক্বামাত বলা হয়, তখন আবার দূরে সরে যায়। ইক্বামাত শেষ হলে সে পুনরায় ফিরে এসে লোকের মনে কুমন্ত্রণা দেয় এবং বলে এটা স্মরণ কর, ওটা স্মরণ কর, বিস্মৃত বিষয়গুলো সে মনে করিয়ে দেয়। এভাবে লোকটি এমন পর্যায়ে পোঁছে যে, সে কয় রাক’আত সালাত আদায় করেছে তা মনে করতে পারে না। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৬০৮)