যুগে যুগে জালেমকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যারা কারবালার ময়াদানের হাদীসের ভুল ব্যাখা করে ইয়াজিদের নামের শেষে “রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু” উচ্চারণ করে থাকে।
♦♦কুসতুনতুনিয়া-বিষয়ক হাদীসের অপব্যাখ্যার অপনোদন♦♦
★ ”…তিনি মহানবী (দ:)-কে বলতে শুনেছেন, ‘নৌযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আমার সাহাবীদের প্রথম দলটি জান্নাতী হবে।’ মহানবী (দ:) এর পর বলেন, ‘আমার সাহাবীদের মধ্যে প্রথম বাহিনী যারা (রোমের) সিজারের শহর জয় করবে, তাদের গুনাহ মাফ করা হবে’।” [সহীহ বুখারী, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস – ১৭৫]
এখানে রোমের শহর বলতে হিমসকে (রোম সম্রাজ্যের ১ম শহর) বুঝিয়েছে যা আবু উবাইদা ইবনে জারারাহ (রা:) সময় বিজয় করা হয়। আর যদি রোমের শহর বলতে ইস্তাম্বুল বুঝায় তা সাহাবীদের যুগে বিজয় হয় নি, তা সুলতান ফতেহ মাহমুদের সময় হয়।
হাদীসের দুটো ব্যাখা করলেও ইয়াজিদের নাম আসে না
★আবু দাউদের সুনানে বর্ণিত সহীহ হাদীসে বিবৃত হয়েছে:
عن أسلم أبي عمران قال : غزونا من المدينة نريد القسطنطينية وعلى الجماعة عبد الرحمن بن خالد بن الوليد
হযরত আসলাম আবি ইমরান (রা:) বলেন, “আমরা কনস্টানটিনোপোল জয়ের উদ্দেশ্যে মদীনা হতে বের হই। আবদুর রহমান বিন খালেদ বিন ওয়ালিদ ছিলেন এই বাহিনীর প্রধান।” [সুনানে আবি দাউদ, ২য় খণ্ড, হাদীস নং ২৫১২; আলবানীও এই হাদীসকে সহীহ বলেছে তার ‘তাখরিজ’ পুস্তকে]
★ইমাম তাবারী নিজ ‘তারিখ’ গ্রন্থে বলেন –
فمما كان فيها من ذلك دخول المسلمين مع عبد الرحمن بن خالد بن الوليد بلاد الروم ومشتاهم بها وغزو
আবদুর রহমান বিন খালেদ বিন ওয়ালিদের সেনাপতিত্বে ৪৪ হিজরী সালে মুসলমান বাহিনী রোমে (কনস্টানটিনোপোল) প্রবেশ করেন এবং সেখানে গযওয়া (ধর্মযুদ্ধ) সংঘটিত হয়। [তারিখে তাবারী, ৪৪ হিজরীর ঘটনা, ৫ খণ্ড, ২১২ পৃষ্ঠা; কায়রোর ‘দারুল মা’আরিফ’ প্রকাশনী হতে প্রকাশিত]
একটু খেয়াল করুন রোম বলতে যুগে যুগে মূলত ইস্তাম্বুলকে বুঝাত আর শেষ জমানায় রোমের ব্যাখায় রুমকে কেউ বলছে আমেরিকার-ইউরোপ বা কেউ রাশিয়া। মূলত রোম বলতে রোমান সম্রাজ্যকে বুঝাত যা গ্রীস, তুরস্ক, সিরিয়াসহ বহু জায়গা জুড়ে বিস্তৃত ছিল।
অথচ ইয়াযীদ আরও বহু পরে ওখানে যায়। উপরন্তু, তাকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল শাস্তিস্বরূপ; আর সে ওই প্রথমে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের প্রতি বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করেছিল।
★ইমাম ইবনে আসীর (রহ:) লিখেন:
في هذه السنة وقيل : سنة خمسين سير معاوية جيشًا كثيفًا إلى بلاد الروم للغزاة ، وجعل عليهم سفيان بن عوف ، وأَمَرَ ابنه يزيد بالغزاة معهم فتثاقل واعتلّ فأمسك عنه أبوه ، فأصاب الناس في غزاتهم جوعٌ ومرض شديد ، فأنشأ يزيد يقول :
ما إن أبالي بما لاقت جموعهم *** بالفرقدونة من حمى ومن موم
إذا اتكأت على الأنماط مرتفقًا *** بدير مروان عندي أم كلثومِ
فبلغ معاوية شعره، فأقسم عليه ليلحقنّ بسفيان في أرض الروم، ليصيبه ما أصاب الناس، فسار ومعه جمع كثير أضافهم إليه أبوه
”এই বছর, অর্থাৎ, ৪৯ বা ৫০ হিজরী সালে হযরত আমীরে মোয়াবিয়া (রা:) রোমের (কনস্টানটিনোপোল) উদ্দেশ্যে এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। তিনি এর দায়িত্বভার অর্পণ করেন সুফিয়ান বিন আউফের প্রতি এবং তাঁর ছেলে ইয়াযীদকে ওই বাহিনীর সাথে যেতে বলেন। কিন্তু ইয়াযীদ ‘অসুস্থ হওয়ার ভান করে এবং যেতে অস্বীকৃতি জানায়’।
যোদ্ধারা যখন ক্ষুধা ও রোগ-ব্যাধিগ্রস্ত হন, তখন সে ব্যঙ্গ করে কবিতায় বলে, ‘ফারকুদওয়ানা- এ মহা গযবে তারা পতিত হয়েছে; তাদের জ্বর বা অন্য যা-ই কিছু হোক, তাতে আমার যায় আসে না। কেননা, আমি বসে আছি উচ্চ ফরাশে (ম্যাট্রেস); আর আমার বাহুবন্ধনে আছে উম্মে কুলসুম (ইয়াযীদের স্ত্রীদের একজন)।’
”হযরত আমীরে মোয়াবিয়া (রা:) যখন এই কবিতার শ্লোক সম্পর্কে জানতে পারেন, তখন তিনি ইয়াযীদকে শপথ গ্রহণ করতে ও কনস্টানটিনোপোলে সুফিয়ান ইবনে আউফের সাথে যোগ দিতে বাধ্য করেন, যাতে করে ’সেও ইসলামের মোজাহিদদের মোকাবেলাকৃত কঠিন পরীক্ষার অংশীদার হতে পারে’ (এটি ইয়াযীদের প্রতি শাস্তি ছিল)। এমতাবস্থায় ইয়াযীদ অসহায় হয়ে পড়ে এবং তাকে যুদ্ধে যেতে হয়; আর
হযরত আমীরে মোয়াবিয়া (রা:) তার সাথে আরেকটি বাহিনী প্রেরণ করেন।” [’তারিখে ইবনে আল-আসীর’, ৩য় খণ্ড, ১৩১ পৃষ্ঠা]
★ইমাম বদরুদ্দীন আইনী (রহ:) বলেন:
قلت: الأظهر أن هؤلاء السادات من الصحابة كانوا مع سفيان هذا ولم يكونوا مع يزيد بن معاوية، لأنه لم يكن أهلاً أن يكون هؤلاء السادات في خدمته
”আমি বলি, অসংখ্য সাহাবী (রা:) হযরত সুফিয়ান ইবনে আউফ (রা:)-এর অধীনে যুদ্ধে গিয়েছিলেন এবং ‘ইয়াযীদ ইবনে মোয়াবিয়ার নেতৃত্বে যান নি, কেননা সে তাঁদেরকে নেতৃত্বদানে অযোগ্য ছিল’।” [‘উমদাতুল কারী’, শরহে সহীহ আল-বোখারী, ১৪/১৯৭-১৯৮]
★কনস্টানটিনোপোলে সেনা অভিযানের সার-সংক্ষেপ নিম্নরূপ:
- প্রথম আক্রমণ পরিচালিত হয় ৪২ হিজরী সালে।
- দ্বিতীয় দফায় আক্রমণ হয় ৪৩ হিজরীতে এবং এর সেনাপতি ছিলেন হযরত বসর বিন আবি আরকা।
- তৃতীয় অভিযান পরিচালনা করা হয় ৪৪ হিজরী সালে এবং এটির নেতৃত্ব দেন আবদুর রহমান বিন খালেদ বিন ওয়ালীদ।
*৪র্থ বার পরবর্তী অভিযান ছিল ৪৬ হিজরীতে যার সেনাপতি ছিলেন মালিক বিন আবদির্ রহমান ও আবদুর রহমান বিন খালেদ বিন ওয়ালীদ। - ৪৭ হিজরীতে পরবর্তী অভিযান পরিচালনা করেন মালিক বিন হোবায়রা ও আবদুর রহমান বিন কায়েমী।
- ৪৯ হিজরী সালে কনস্টানটিনোপোল তিনবার আক্রমণ করা হয়।
*আর সর্বশেষ ৫০ হিজরীতে যে অভিযান পরিচালিত হয় তাতে “”ইয়াযীদ”” যোগ দেয় ।
★হযরত আমীরে মোয়াবিয়া (রা:) ইয়াযীদকে আটক করে সিজারের ওখানে পাঠান, কারণ সে মোজাহিদীনবৃন্দের প্রতি বিদ্রূপ করতো। তাই শাস্তিস্বরূপ তাকে ওখানে পাঠানো হয়েছিল, জ্বেহাদের জন্যে নয়।
অতএব, ইয়াযীদ সপ্তম সেনা অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিল, প্রথম অভিযানে নয়। আর বোখারী শরীফে উল্লেখিত হয়েছে, “আমার উম্মতের মধ্যে সিজারের নগরী আক্রমণকারী প্রথম সেনা দলের পাপ-পঙ্কিলতা মাফ করা হবে।”
~রেফারেন্স~
★ইবনে কাসিরের আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া
★ইবনে খালদুনের ইতিহাস
★ইমাম ইবনে আসীরের ইতিহাস
শেষ জমানায় হয়তো এভাবে ঈমাম মাহাদী হাফিঃ কে শত্রু ও সুফিয়ানীকে (যিনি আবু সুফিয়ানের বংশধর) আলেমরা বহু হাদীসের ভুল ব্যাখা করে প্রতিষ্ঠা করবে।