গনতন্ত্রবাদীদের ধোকা পর্ব-১ (মদীনার সনদ)

মদীনার সনদ ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেকে এটাকে ভুল ব্যাখা করে অভিমত প্রচার করে – সকল ধর্মের মতানুযায়ী শাসনব্যবস্থার পক্ষে দলিল দেয়। অথচ মদীনার সনদের বহু আগে মুসলিমরা কালেমা পড়ে সংকল্প করে একমাত্র আল্লাহ ও তার রসুলের (সা:) অনুগত্য করার। মদীনার রাষ্ট্রের সংবিধান ছিল আল কুরআন আর রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন রসুল (সা:)।

অপরদিকে আল্লাহ বলেন,

মুমিনগণ যেন ঈমানদারদের পরিবর্তে কাফিরদেরকে নিজেদের বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক রূপে গ্রহণ না করে। যে এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহর কোনও সম্পর্ক থাকবে না। অবশ্য তাদের নির্যাতন থেকে বাচার জন্য এরূপ করলে আল্লাহ্ মাফ করবেন। (সুরা আল ইমরান)

মদীনার সনদ হল মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব চুক্তি এবং ইয়াহুদীদের সাথে রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতি মেনে নিজ ধর্ম পালনের অধিকার চুক্তি। রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে তাদের ধর্মমত বা মানবরচিত বিধান চলবে না।

ধরুন বিশ্বের সকল গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকল ধর্মের লোক তার ধর্ম পালন করতে পারে। কিন্তু চুরি, হত্যার শাস্তি সকল ধর্মের লোককে পেতে হবে মানবরচিত আইন অনুযায়ী সমভাবে। তেমনি সকল ধর্মের লোককে ট্রাফিকসহ বহু কমন নিয়ম মানতে হয় নাহলে জরিমানা বা শাস্তি আছে। তেমনি বহুদেশে আজও উলঙ্গ থাকাকে অশালীন ভাবা হয়, আইন অনুযায়ী সকল ধর্মের লোককে নূন্যতম পোশাক পড়তে হয়। আর ইসলামী জীবনব্যবস্থা পরিপূর্ণ শালীনতার দিকে আহবান করে।

খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু সকল ধর্মেই পর্দার বিধান আছে। সবাই ঠিকই মেনে চলছে একে উগ্রবাদ বলছে না, অথচ ইসলামের বিধান চাইলে ওরা প্রশ্ন ছুড়ে বিধর্মীদের উপর আঘাত আসবে! এটা উগ্রবাদ। আহ! আল্লাহর বিধানের চেয়ে কল্যানকর কি কিছু আছে!? তার মানে আপনারা বলতে চাইছেন আল্লাহর বিধানের চেয়ে মানবরচিত বিধান উত্তম?

এবার মদীনার সনদের কিছু চুক্তি দেখে নিই- গনতন্ত্রবাদীরা কি তা করতে সক্ষম হবে?

কুরায়শী এবং ইয়াছরিবী মুসলমান এবং তাদের অনুসারীদের মধ্যে উম্মী নবী মুহাম্মদ (সা) এ সনদ জারী করেন।

=> এক জাতি হিসাবে তারা জিহাদে অংশ গ্রহণ করবে অন্যদের মুকাবিলায়।

এখানে মুসলিমদের জিহাদে অংশগ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে, আর কাফেররা জিজিয়া দিয়ে সাহায্য করবে।
তবে সেনা, বিচার বিভাগে অংশগ্রহন করতে পারবে না যতক্ষণ না ইসলাম গ্রহন করে। কারন যতক্ষণ না ইসলাম গ্রহন করে তাদের বন্ধু ভাবা যাবে না। আর শাসনব্যবস্থা যেহেতু কুরআন দ্বারা সুতরাং মুমিন ইলমের কারনে যোগ্য।

এরপর তিনি আনসারদের প্রত্যেক বংশ-গোত্র-এর উল্লেখ করেন। এরা হলো, বনু সাইদা, বনু জুশাম, বনু নাজ্জার, বনু আমর ইবন আওফ, বনু নাবীত। এমনকি চুক্তিতে তিনি একথাও উল্লেখ করেন যে, কোন মুসলমান ঋণভারে জর্জরিত বিপন্ন জনগোষ্ঠীকে আশ্রয়হীন রাখবে না এবং ফিদিয়া আর দিয়্যতের ক্ষেত্রে নিয়ম-রীতি অনুযায়ী পরস্পরের সাহায্য-সহায়তা করবে।

=> মু’মিন মুত্তাকীরা ঐক্যবদ্ধ মোর্চা গঠন করবে বিদ্রোহী, যালিম, অত্যাচারী, পাপাচারীর বিরুদ্ধে, মু’মিনদের মধ্যে ফাসাদ ও বিপর্যয় সৃষ্টির বিরুদ্ধে। এমনকি আপন সন্তানদের বিরুদ্ধে গেলেও এ মোর্চা গঠন করতে হবে এবং এ ব্যাপারে সকলে নবী মুহাম্মদ (সা)-কে সহায়তা করবে।

=> কোন কাফিরের বদলায় কোন মু’মিন কোন মু’মিনকে হত্যা করবে না। (অথচ আজ গনতন্ত্রের চেতনাধারী নাস্তিক, মুরতাদ বাঁচাতে নিরীহ মুমিনের বুকে গুলি করে।)

=> মু’মিনের বিরুদ্ধে কোন কাফিরকে সাহায্য করা যাবে না। (আর আজ কাফের রাষ্ট্র বা কাফের নেতাদের সাক্ষাৎ, সমর্থনকে বড় মনে করে তথাকথিত মুসলিম নেতারা। ওদের খুশি করতে মুমিন মুসলিমদের উপর আঘাত হানে।)

=> অন্যদের মুকাবিলায় মুসলমানগণ পরস্পরে ভাই।

=> আমাদের অনুগত ইয়াহুদীরা সাহায্য-সহায়তা পাওয়ার যোগ্য। তাদের প্রতি জুলুম করা যাবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে সাহায্য-সহযোগিতা করা যাবে না।

=> সকল মুসলমানের নিরাপত্তা আর স্বার্থ এক। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে কোন মু’মিন অপর মু’মিন ভাইকে বাদ দিয়ে সন্ধি চুক্তি করবে না। তা সমভাবে সকলের জন্য ইনসাফ ভিত্তিক হতে হব।

=> যে সব যোদ্ধা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে শরীক হবে, তারা একে অন্যের সহায়তা করবে।

=> মু’মিনগণ আল্লাহর রাস্তায় নিহতদেরকে পরস্পরে সহায়তা করবে।

=> কোন মু’মিন ব্যক্তি, যে এ সনদের অন্তর্ভুক্ত বিষয়ে ঈমান রাখে এবং তা স্বীকার করে, আল্লাহ্ এবং শেষ দিনে যার ঈমান ও বিশ্বাস আছে, কোন নতুন কিছু উদ্ভাবনকারীর সাহায্য সহায়তা করা তার জন্য হালাল নয়, হালাল নয় এমন নব উদ্ভাবনকারীকে আশ্রয় দান করা। যে ব্যক্তি এমন লোককে সাহায্য-সহযোগিতা করবে বা তাকে আশ্রয় দান করবে কিয়ামতের দিন তার প্রতি আল্লাহর লা’নত, আল্লাহর গযব আপতিত হবে। তার নিকট থেকে কোন বিনিময় গ্রহণ করা হবে না (তার তাওবাও কবুল করা হবে না)।

বিদআতিদের ব্যাপারে ইসলাম কতটা কঠোর। রসুল (সা:) ও সাহাবীদের ইসলামী রাষ্ট্রে বিদআত প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হতো। আজ গনতন্ত্রবাদীরা ভন্ড পীরদের মাজার, ইসলামের নামে শির্ক ও কুফর ছড়ানো কারীদের বিরুদ্ধে বলায় উল্টো ওদের পক্ষে নিয়ে প্রকৃত মুসলিমদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

ক্ষমতা পেলে তারা বিদআতিদের সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এবং এর বিরোধিতাকারীদের কঠোর শাস্তির ঘোষণা তাদের অনেকে দেন।

আসলে কি ওরা রসুলের (সা:) সুন্নাহ মানছে নাকি আবু জাহেলদের?

=> চুক্তির ক্ষেত্রে কোন বিরোধ, মত-পার্থক্য দেখা দিলে (তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

=> ইয়াহুদীরা যতদিন মু’মিনদের সহযোদ্ধা রূপে থাকবে, ততদিন তারা মু’মিনদের সাথে ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ থাকবে। জিজিয়া দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র ও তার নাগরিক রক্ষায় ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে প্রতিটি রাষ্ট্র নাগরিকদের করের টাকা নিরাপত্তা ও প্রশাসনের কাজে ব্যয় হয়! তখন এটাকে উগ্রবাদ বলে না।

=> ইয়াহুদীরা তাদের ধর্ম মেনে চলবে আর মু’মিনরা মেনে চলবে তাদের নিজেদের দীন।

=> কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করলে তা করবে নিজেরই সঙ্গে, তবে জুলুমের বিপরীতে জুলুমের শাস্তি তাকে পেতে হবে। (প্রতিটি রাষ্ট্রে রাষ্ট্রদ্রোহীতার জন্য শাস্তি দেয়, তখন তা জায়েজ মনে হয়)

=> ইয়াহুদীরা নিজেদের ব্যয়ভার বহন করবে, আর মুসলমানরা বহন করবে নিজেদের ব্যয়ভার।

=> এ চুক্তিপত্রের অনুসারীর বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ করবে, তার বিরুদ্ধে সাহায্য করা সকলের কর্তব্য হবে।

=> মজলুমের সাহায্য-সহযোগিতা করা হবে।

=> প্রতিবেশী-আশ্রয়প্রার্থী হবে নিজের মতো- যদি সে ক্ষতিকর এবং অপরাধী না হয়।

=> অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত কোন নারীকে আশ্রয় দেয়া যাবে না। (আর বর্তমানে অভিভাবকদের অনুমতি ছাড়া বিবাহের বৈধতাও হয়।)

=> এ চুক্তির পক্ষের মধ্যে কোন ঘটনা-উত্তেজনায় বিপর্যয়ের আশংকা সৃষ্টি হলে (বা কোন বিরোধ দেখা দিলে) ব্যাখ্যার জন্য আল্লাহ্ এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

যে এ চুক্তি মেনে চলবে আল্লাহ তাকে রক্ষা করবেন।

=> কুরায়শ (মক্কার কাফের) এবং তাদের সাহায্যকারীকে আশ্রয় দেয়া যাবে না। অর্থাৎ মুসলিমদের শত্রুদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দেওয়া যাবে না।

=> কেউ ইয়াছরিবের উপর চড়াও হলে সকল পক্ষ মিলে ঠেকাবে।

=> মুসলমানদেরকে কোন সন্ধি-চুক্তির জন্য আহ্বান করা হলে তারাও (ইয়াহুদীরা) তা মেনে চলবে। ইয়াহুদীরা কারো সঙ্গে চুক্তি করলে মুসলমানরাও তাতে যোগ দিবে। তবে কেউ দীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে তাতে মুসলমানরা যোগ দেবে না।

=> প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য তার অংশের সংরক্ষণ করা।

=> কেউ মদীনার বাইরে গেলে বা মদীনায় বসবাস করলে, সে নিরাপত্তা লাভ করবে- যদি সে জালিম এবং অপরাধী না হয়ে থাকে।

যে ব্যক্তি পুণ্যবান এবং মুত্তাকী, আল্লাহ হবেন তার হিফাযতকারী।

(আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া – ৩য় খন্ড, সংক্ষিপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *