খেলাফত ও আহলে বায়াতের সংগ্রাম

মুসলিম অর্থ আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণকারী অর্থাৎ সে নিজ মতবাদ, নফসের অনুসরণ বাদ দিয়ে আল্লাহর কিতাব ও রসুলল্লাহ’র (সা:) অনুসরণ করে চলবে। বিধানদাতা হিসেবে এক আল্লাহকে মানবে, কারো গোলামী করবে না।

ইসলাম এসেছে মানুষকে মানুষের দাসত্ব হতে মুক্ত করে এক আল্লাহর দাসত্ব মেনে নিতে যেন তা ব্যক্তিজীবন হতে রাষ্ট্রীয়জীবনে সর্বত্র মানুষ মুক্তভাবে দ্বীন পালন করতে পারে। দ্বীনের গন্ডির ভেতর যেকোন মতবাদ প্রকাশের অধিকার ছিল। শাসক নির্বাচনে মজলিসে শুরার রায় দিত। খেলাফায়ে রাশেদীনের যেকোন সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে প্রতিবাদ জানাতে পারতো বিনা ভয়ে। হযরত উমরের (রা:) মত কঠোর ব্যক্তির পোষাকেরও জবাবদিহিতা করতে পারতো! আজকে ক্ষমতাসীনদের সবচেয়ে নিম্নপদের লোকের সম্পদের হিসাব চাইলে জুলুম, নির্যাতন শুরু হবে।

ধীরে ধীরে উম্মাহর বুকে রাজতন্ত্র চালু হল, শাসকের বিরোধিতা করলে জুলুমের শিকার হতে হতো।

আহমাদ ইবন মানী’ (রহঃ) ….. সাফীনা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমার উম্মতের খিলাফত হবে ত্রিশ বছর। এরপর হবে বাদশাহী। সহীহ, সহিহাহ ৪৫৯,

নু’মান বিন বশীর (র) আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর গোপন বিষয়ের জ্ঞানধারণকারী হুযাইফা (র) হতে বর্ণনা করেন, আমি আল্লাহর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে শাসকদের সম্পর্কে হাদিস মুখস্থ রেখেছি। তিনি বলেন: “নবুওয়্যাত তোমাদের মাঝে থাকবে, যতদিন মহান আল্লাহ চান, এরপর তিনি তা উঠিয়ে নেবেন যখন তিনি চান। অতপর, নবুওয়্যাতের আদলে খিলাফাহ আসবে এবং তা বিদ্যমান থাকবে যতদিন তিনি চান এবং তিনি উঠিয়ে নেবেন যখন তিনি চান। অত:পর আসবে উত্তরাধিকার সূত্রে রাজতন্ত্র এবং তা থাকবে যতদিন মহান আল্লাহ চান এবং তিনি তা উঠিয়ে নেবেন যখন চান। অতঃপর আসবে চরম জবরদস্তির শাসন, যা থাকবে যতদিন মহান আল্লাহ চান এবং যখন তিনি চান, তা উঠিয়ে নেবেন। অতঃপর আসবে নবুওয়্যাতে আদলে খিলাফাহ। এর পর তিনি চুপ হয়ে গেলেন। মুসনাদে আহমাদ ১৮৪৩০(৪র্থ খন্ড,পৃষ্ঠা-২৭৩)

খেলাফায়ে রাশেদীনের যুগের পর হতে উম্মাহর বুকে চেপে আসে রাজতন্ত্র, তার মধ্যে কিছু ভালো খলিফা ছিল (আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা, উমর ইবনে আবদুল আজিজ রহ)। ইসলামের অনেক অগ্রগতি হয়েছিল – কিন্তু শাসকরা নিজেদের ক্ষমতা বাচাতে মুসলিমদের হত্যা করেছিল।

ইসলামের জন্য উসমানের (রা:) অবদান ছিল সর্বোচ্চ। তার হত্যাকে কেন্দ্র করে ফেতনা উদ্ভব হয় বনু উমাইয়ার অনেকে তার হত্যা ইস্যুকে নিজের ক্ষমতা স্বার্থে ব্যবহার করেন। যে কেউ তাদের বিরোধীতা করলে উসমানের (রা:) হত্যাকারী দলের লোক বলে অপবাদ দিত এমনকি হত্যা করত। যে তালহা (রা:) উসমানের (রা:) রক্ষায় দৃঢ় ছিলেন, উসমান (রা:) হত্যার বিচারের দাবিতে শেষ পর্যন্ত মুনাফেকের ষড়যন্ত্রে যুদ্ধে নেমেছিলেন তাকে হত্যা করা হয়।

খেলাফায়ে রাশেদীনের পর হতে নিজেদের সুবিধার্থে ইসলামের ফেরকার অনুপ্রবেশে বাধা না দিয়ে বরং সহায়তা করেছিল। যেন দরবারী আলেমদের দিয়ে তাদের রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখা যায়। যেমন – উমাইয়াদের সময় জাবারিয়া ফেতনার প্রসার পায় – এর দ্বারা বিরোধিতার হত্যার সর্মথন দেওয়া হতো। তাদের শাসনামলে আহলে বায়াত ও আব্বাসীদের উপর হত্যাকান্ড, নির্যাতন চলে।

কারবালা ও আহলে বায়াতের মহব্বতের নামে আব্বাসীরা ক্ষমতায় আসে, এবং বনু উমাইয়াদের নিরীহদের উপরও জুলুৃম চালায় কিন্তু আহলে বায়াত প্রাপ্য সম্মান পায়নি। আব্বাসীদের অনেকে নিজেদের সুবিধার্থে কাদেরিয়া মতবাদের সমর্থন ও প্রসার করে প্রথমে।

অনেকে এসব আলোচনা করলে আমাদের ফেতনাবাজ, ইসলামের ভুল ব্যাখাকারী উপাধি দেন- অথচ তারা যাদের হক্বপন্হী ঈমাম মানেন – ঈমাম আবু হানিফা (রহ:) ও ঈমাম মালেক(রহ:) রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গিয়ে আহলে বায়াতের পক্ষে নেন। মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহর (নফসে জাকিয়া,যিনি হাসান (রা:) বংশধর ) পক্ষ নিয়ে রাজতন্ত্রের বিপক্ষে গিয়ে আর্থিক সাহায্য ও বায়াআত করার কারনে ঈমামদের উপর জুলুম নির্যাতন হয়। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)

খলিফা মাহাদী হাফি আসা পর্যন্ত খেলাফতের সাথে আহলে বায়াতের সম্পর্ক থাকবে এমনকি আরেকজন নফসে জাকিয়াকে হত্যা করা হবে এরপর মাহাদী হাফি আসবে। পরবর্তীতে এই নিয়ে আলোচনা আসবে।

আল হাকিমের মুস্তাদরাকুস সাহীহাইন গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত হাদীসটি হুবহু নিচে উল্লেখ করা হলো:

আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন: আমরা মহানবী (সা.)-এর সমীপে উপস্থিত হলাম।

তিনি অত্যন্ত হাস্যোজ্জ্বল মুখে ও আনন্দের সাথে আমাদের বরণ করলেন। আমরা তাঁর কাছে যা জিজ্ঞাসা করলাম সে ব্যাপারে তিনি উত্তরও দিলেন।

আর আমরা নীরব হলে তিনি কথা বলে যাচ্ছিলেন। আর ঐ সময় একদল হাশিম বংশীয় যুবক সেখান দিয়ে যাচ্ছিল যাদের মধ্যে ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনও ছিলেন।

মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টি তাদের ওপর পড়লে তাঁর দু’নয়ন অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল। আমরা তখন বললাম হে রাসূলাল্লাহ্! আমরা প্রায়ই অপনার মুখমণ্ডলে এমন কিছু দেখতে পাই যা আমাদেরকে কষ্ট দেয়।

মহানবী (সা.) বললেন: আমরা এমন এক পরিবার, মহান আল্লাহ্ আমাদের জন্য পার্থিব জগতের ওপর আখেরাতকে মনোনীত করেছেন। শীঘ্রই আমার পরে আমার আহলে বাইত শহর-নগর, অঞ্চল ও দেশসমূহে শরণার্থীর মতো ছড়িয়ে পড়বে।

আর এ অবস্থা ঐ সময় পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে যখন প্রাচ্য থেকে কালো পতাকাসমূহ উত্থিত হবে ও পতপত করে উড়তে থাকবে।

কালো পতাকাবাহীরা তাদের ন্যায্য অধিকার দাবি করবে। তবে তাদের অধিকারসমূহ প্রদান করা হবে না।

এজন্য তারা তাদের অধিকারসমূহ থেকে হাত গুটিয়ে নেবে না। কিন্তু তাদের দাবির প্রতি সাড়া দেয়া হবে না।

তারা পুনরায় তাদের অধিকার চাইবে কিন্তু তাদের দাবির প্রতি গুরুত্ব দেয়া হবে না।

এমতাবস্থায় তারা সংগ্রাম করার পথ বেছে নেবে এবং বিজয়ী হবে। যদি তোমাদের মধ্য থেকে কেউ অথবা তোমাদের বংশধরদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি ঐ সময় বিদ্যমান থাকবে তখন তার উচিত হবে আমার আহলে বাইতভুক্ত নেতার সাথে যোগ দেয়া, এমনকি কষ্ট করে বরফের ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তার সঙ্গে যোগ দেবে।

কারণ, এ সব কালো পতাকা হবে হেদায়েতের পতাকা যেগুলো আমার আহলে বাইতের এক ব্যক্তির (ইমাম মাহদী) হাতে তারা অর্পণ করবে, যার নাম হবে আমার নামের অনুরূপ এবং যার পিতার নাম হবে আমার পিতার নাম। সে পৃথিবীর অধিপতি হবে এবং এ পৃথিবী অন্যায়, অত্যাচার ও বৈষম্যে পরিপূর্ণ হয়ে যাবার পর সে তা ন্যায় ও সুবিচার দিয়ে পূর্ণ করে দেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *