ইসলাম এসেছে মানুষকে মানুষের দাসত্ব হতে মুক্ত করে এক আল্লাহর দাসত্ব মেনে নিতে যেন তা ব্যক্তিজীবন হতে রাষ্ট্রীয়জীবনে সর্বত্র মানুষ মুক্তভাবে দ্বীন পালন করতে পারে। দ্বীনের গন্ডির ভেতর যেকোন মতবাদ প্রকাশের অধিকার ছিল। শাসক নির্বাচনে মজলিসে শুরার রায় দিত। খেলাফায়ে রাশেদীনের যেকোন সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে প্রতিবাদ জানাতে পারতো বিনা ভয়ে। হযরত উমরের (রা:) মত কঠোর ব্যক্তির পোষাকেরও জবাবদিহিতা করতে পারতো!! আজকে ক্ষমতাসীনদের সবচেয়ে নিম্নপদের লোকের সম্পদের হিসাব চাইলে জুলুম, নির্যাতন শুরু হবে।
ধীরে ধীরে উম্মাহর বুকে রাজতন্ত্র চালু হল, শাসকের বিরোধিতা করলে জুলুমের শিকার হতে হতো।
আহমাদ ইবন মানী’ (রহঃ) ….. সাফীনা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমার উম্মতের খিলাফত হবে ত্রিশ বছর। এরপর হবে বাদশাহী। সহীহ, সহিহাহ ৪৫৯,
ইউসুফ ইবনু মাহাক থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, মারওয়ান ছিলেন হিজাযের গভর্নর। তাকে নিয়োগ করেছিলেন মু’আবিয়াহ (রাঃ)। তিনি একদা খুতবা দিলেন এবং তাতে ইয়াযীদ ইবনু মুআবিয়ার কথা বারবার বলতে লাগলেন, যেন তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তার বায়’আত গ্রহণ করা হয়। এ সময় তাকে ‘আবদুর রহমান ইবনু আবু বকর কিছু কথা বললেন। মারওয়ান বললেন, তাঁকে পাকড়াও কর। তৎক্ষণাৎ তিনি আয়িশাহ (রাঃ)-এর ঘরে চলে গেলেন। তারা তাঁকে ধরতে পারল না।
তারপর মারওয়ান বললেন, এ তো সেই লোক যার সম্বন্ধে আল্লাহ্ অবতীর্ণ করেছেন, “আর এমন লোক আছে যে, মাতাপিতাকে বলে, তোমাদের জন্য আফসোস! তোমরা কি আমাকে এ ভয় দেখাতে চাও যে, আমি পুনরুত্থিত হব যদিও আমার পূর্বে বহু পুরুষ গত হয়েছে, তখন তার মাতাপিতা আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করে বলে, দুর্ভোগ তোমার জন্য। বিশ্বাস স্থাপন কর, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অবশ্যই সত্য। কিন্তু সে বলে এ তো অতীতকালের উপকথা ব্যতীত কিছুই নয়।” (একথা শুনে উম্মুল মুমিনীন “আয়েশা (রা:) পর্দার আড়াল থেকে বললেনঃ “আল্লাহ্ আমাদের ব্যাপারে কুরআনে কিছুই নাযিল করেন নি, কেবলমাত্র আমার নির্দোষিতা ছাড়া”)।
সুনানুন নাসাই আল কুবরা ও মুসতাদরাক লিল হাকিমের বর্ণনায়ঃ
মুহাম্মাদ বিন যায়দ বর্ণনা করেন যে যখন মু’আবিয়াহ তার ছেলের জন্য বায়আত নিচ্ছিলেন, মারওয়ান বললঃ “এটি আবু বাকার ও উমারের সুন্নাহ”। “আব্দুর রহমান জবাব দিলেনঃ “এটি হারকাল ও কায়সারের সুন্নাহ্”। তখন মারওয়ান বললঃ “এই সেই ব্যক্তি, যার ব্যাপারে কুরআনে অবতীর্ণ হয়েছে, আর এমন লোক আছে যে, মাতাপিতাকে বলে, তোমাদের জন্য আফসোস! তোমরা কি আমাকে এ ভয় দেখাতে চাও যে, আমি পুনরুত্থিত হব যদিও আমার পূর্বে বহু পুরুষ গত হয়েছে, তখন তার মাতাপিতা আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করে বলে, দুর্ভোগ তোমার জন্য। বিশ্বাস স্থাপন কর, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অবশ্যই সত্য। কিন্তু সে বলে এ তো অতীতকালের উপকথা ব্যতীত কিছুই নয়। [সুরা আহক্বাফ ৪৬:১৭] ।
একথা শুনে ‘আইশাহ্ বললেনঃ “আল্লাহর কসম! সে মিথ্যা বলেছে, আল্লাহ্ এই আয়াত আমাদের ব্যাপারে অবতীর্ণ করেননি। আর আমি যদি চাই, তাহলে বলতে পারি এই আয়াত কার সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। আমি আল্লাহর রসুল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে মারওয়ান ও তার পিতার ওপর লা’নত করতে শুনেছি, যখনও মারওয়ান জন্ম নেয়নি। কাজেই, মারওয়ান আল্লাহর লা’নতের ভাগীদার”।
সুনানুন নাসাই আল কুবরাঃ ১১৪৯১, মুস্তাদরাক লিল হাকিমঃ ৮৪৮৩, ইমাম হাকিম বলেনঃ হাদিসটি বুখারী মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ).।
ইসলামের জন্য উসমানের (রা:) অবদান ছিল সর্বোচ্চ। তার হত্যাকে কেন্দ্র করে ফেতনা উদ্ভব হয় বনু উমাইয়ার অনেকে তার হত্যা ইস্যুকে নিজের ক্ষমতা স্বার্থে ব্যবহার করেন। যে কেউ তাদের বিরোধীতা করলে উসমানের (রা:) হত্যাকারী দলের লোক বলে অপবাদ দিত এমনকি হত্যা করত। যে তালহা (রা:) উসমানের (রা:) রক্ষায় দৃঢ় ছিলেন, উসমান (রা:) হত্যার বিচারের দাবিতে শেষ পর্যন্ত মুনাফেকের ষড়যন্ত্রে যুদ্ধে নেমেছিলেন তাকে হত্যা করা হয়।
বিন আয়াস জাবী তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আমরা জামালের যুদ্ধের দিন হযরত আলীর সাথে ছিলাম। হযরত আলী (রাঃ) তালহা বিন উবায়দুল্লাহ (রাঃ) কে তার সাথে দেখা করার জন্য বার্তা পাঠালেন। হযরত তালহা (রা.) তাঁর কাছে এলেন। হযরত আলী (রা.) বললেন, আমি তোমাকে আল্লাহর কসম করে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি আল্লাহর রসূল (সা.)-এর পবিত্র জবান থেকে এই কথাগুলো শুনেছো? রসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন আমি যার মাওলা (অভিভাবক) আলীও তার মাওলা (অভিভাবক)। হে আল্লাহ যে আলীকে সাহায্য করে আপনিও তাকে সাহায্য করুন এবং যে আলীর সঙ্গে শত্রুতা করে আপনিও তার সাথে শত্রুতা করুন। তালহা বললেনঃ হ্যাঁ। হযরত আলী বললেন, তাহলে আমার সাথে যুদ্ধ করছ কেন? হযরত তালহা (রা.) বললেন, আমার মনে ছিল না। এরপর হযরত তালহা (রা.) ফিরে গেলেন। (আল মুসতাদরাক হাকিম-৫৫৯৪)
অপর বর্ননায় রয়েছে –
কায়স বিন হাযিম বর্ণনা করেন: “আমি মারওয়ান বিন হাকামকে দেখেছি তালহা কে তীর দ্বারা আঘাত করতে, যা তার হাঁটুতে বিদ্ধ হয় এবং তিনি শেষ পর্যন্ত মহান আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে ইন্তিকাল করেন। [মুসতাদরাক হাকিম: ৫৫৯১, ইমাম হাকিম এবং যাহাবি হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন]।
এছাড়া আরও রয়েছে -তাবাকাতে ইবনে সাআদ, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা — ২২৩; ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা – ৩৮। ইবনে হাযার, তাহযীবুত তাহযীব, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা-২০। ইবনুল আসীর, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-১২৪। ইবনে আবদুল বার, আল-ইস্তীআব পৃষ্ঠা — ২০৭ ২০৮। ইবনে আবদুল বার বলেন : মারওয়ান হযরত তালহা (রাঃ)-এর সেনাবাহিনীতে শামিল ছিলেন, আর তিনিই হযরত তালহা (রাঃ)-কে হত্যা করেছেন—নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। আল্লামা ইবনে কাসীর আল-বেদায়ায় এ বর্ণনাকেই প্রসিদ্ধ বর্ণনা বলে স্বীকার করেছেন – ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা-২৪৭।
এছাড়া হাদীসে প্রমানিত – আলী (রা:) কে অভিশাপ, গালি দেওয়া হতো। যা উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ:) এসে বন্ধ করেন। বনু উমাইয়াদের মধ্যে সাহাবী পরবর্তী তিনিই শ্রেষ্ঠব্যক্তি ছিলেন। উম্মাহকে খেলাফায়ে রাশেদীনের পথে ফেরানোর জন্য সাহসী ভূমিকা অবতীর্ণ হোন হোসাইন (রা:)। ফলশ্রুতিতেই কারবালা ঘটে।
আর কারবালা ও আহলে বায়াতের মহব্বতের নামে আব্বাসীরা ক্ষমতায় আসে, এবং বনু উমাইয়াদের নিরীহদের উপরও জুলুৃম চালায় কিন্তু আহলে বায়াত প্রাপ্য সম্মান পায়নি। এভাবে যুগ যুগ ধরে রাজতন্ত্র চলছে, তবুও তার মাঝে কিছু ভালো খলিফা ছিল।
জাবির ইনবে সামুরা থেকে বর্ণিত, রাসুল(সাঃ) বলেছেন, “১২ জন খলিফা হবে। তাদের প্রত্যকেই কুরাইশ বংশীয় হবে” সহি বোখারী ৯/৩২৯।
আলেমদের অভিমত হাসান (রা:) পর্যন্ত খলিফা ছিলেন ৫ জন। এছাড়া কেউ আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা:) আবার কেউ উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রা:)-কেও খলিফা ধরেন। আর শেষ খলিফা হবেন মাহাদী (হাফি:)।
আজও দেখবেন ক্ষমতাসীনরা পূর্বপুরুষদের অবদান তাদের ক্ষমতা ও প্রচারের মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। যে কেউ তাদের বিরোধীতা করলে পূর্বপুরুষ হত্যাকারী দলের লোক বা সমর্থক, ও তাদের শান্তিপূর্ন শাসনব্যবস্হা বিরোধী অভিহিত করে জুলুম, নির্যাতন চালায়। বনু উমাইয়া, বনু আব্বাসীদের মত তারাও জানে সঠিক ইসলাম প্রতিষ্ঠা পেলে তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে! তাই সবাই প্রকৃত ইসলামপ্রেমীদের বিরোধিতায় কঠোর।