কেন প্রতি রমাদানে বায়তুল আকসায় ইসরায়েল হামলা করে?

মুসলিমদের পবিত্রভূমি আল আকসা বারবার আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। কিভাবে পবিত্রভূমি বা পবিত্রস্হান মসজিদসমূহে মুসলিমরা আবার পূর্বের মত ইবাদত করতে পারবে তা বুঝতে হলে কুরআন, হাদীস, ইতিহাস, বিশ্বপরিস্হিতির সঠিক জ্ঞান প্রয়োজন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যান্ত—যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।”

সুরা বনি ইসরাইল, ১৭: ১

● আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মসজিদুল আকসায় এক ওয়াক্ত সালাত ৫০ হাজার সালাতের সমান।’

মসজিদুল আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাস ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ। যেটি জেরুসালেমের পুরনো শহরে অবস্থিত। মুহাম্মদ (সা.) মিরাজের রাতে মসজিদুল হারাম থেকে আল-আকসা মসজিদে এসেছিলেন এবং এখান থেকে তিনি ঊর্ধ্বাকাশের দিকে যাত্রা করেন। এটি নির্মাণ করেছিলেন নবি ইসহাক (আ.)। আর পুনরায় র্নির্মাণ ও পরিপূর্ণ করেছিলেন নবি সুলাইমান আলাইহিস সালাম। এটি মুসলিমদের প্রথম কিবলা।

খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাবের আমলে জেরুসালেম বিজয় হলে বর্তমান মসজিদের স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের যুগে মসজিদটি পুনরায় র্নির্মাণ ও সম্প্রসারিত হয়। ৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর এটি আবার নির্মাণ করেন। পরে খলিফা আল-মাহদি এর পূনর্নির্মাণ করেন। ১০৩৩ খৃস্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফাতিমি খলিফা আলি আজ-জাহির পুনরায় মসজিদটি নির্মাণ করেন, যা অদ্যবধি টিকে আছে। মুসলমানদের কাছে জেরুজালেম শহরটি ‘আল কুদস’ নামেও পরিচিত।

● রসুল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন- “আল কুদসের (জেরুজালেম) এমন কোনো জায়গা খালি নেই যেখানে একজন নবি সালাত আদায় করেননি বা কোনো ফেরেশতা দাঁড়াননি।” (জামে তিরমিজি)।

● আবু যার (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, একবার তিনি নবিজিকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! প্রথম নির্মিত মসজিদ কোনটি?’ উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, ‘মসজিদুল হারাম।’ তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, ‘এরপর কোনটি?’ নবিজি (সা.) বললেন, ‘মসজিদুল আকসা।’ আবু যার (রা.) এবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘উভয়টি নির্মাণের মাঝে ব্যবধান ছিল কত বছর?’ তিনি বললেন, ‘চল্লিশ (বছর)।’ এরপর তিনি আরও বললেন, ‘যেখানেই সালাতের সময় হবে, সেখানেই তুমি সালাত আদায় করে নেবে। সেটাই তোমার জন্য মসজিদ।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)।

মোটকথা পৃথিবীর প্রথম মসজিদ হচ্ছে মসজিদুল হারাম বা বাইতুল্লাহ। কিন্তু মসজিদুল হারাম ও মসজিদুল আকসা নির্মাণের মাঝের ব্যবধানের ব্যাপারে যে বলা হলো, তা ছিল চল্লিশ বছর। অথচ আমরা জানি যে, মসজিদুল হারাম নির্মাণ করেছিলেন ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) আর মসজিদুল আকসা নির্মাণ করেছিলেন সুলাইমান (আ.)। ইতিহাস বলে, তাদের মাঝে সময়ের ব্যবধান ছিল এক হাজার বছরেরও বেশি সময়। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন,

“এ হাদিসটি তাদের জন্য বোঝা কষ্টকর যারা এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানে না। কেউ হয়তো বলতে পারে—‘এ তো সবাই জানে যে, নবি সুলাইমান (আ.) মসজিদুল আকসা নির্মাণ করেন। আর ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর মাঝে সময়ের ব্যবধান ছিল প্রায় হাজার বছর।’ আসলে এ কথার দ্বারা ব্যক্তির অজ্ঞতাই স্পষ্ট হয়। কেননা সুলাইমান (আ.) তো শুধুমাত্র আল-আকসাকে পূনরায় নির্মাণ ও নতুন রূপ দান করেছিলেন।
তিনি মোটেও সর্বপ্রথম এটি প্রতিষ্ঠা করেননি বা নির্মাণ করেননি। বরং যিনি প্রকৃতপক্ষে এটি (সর্বপ্রথম) নির্মাণ করেন তিনি হচ্ছেন ইয়াকুব বিন ইসহাক (আ.)। এবং এটি ছিল মক্কায় ইবরাহিম (আ.) কাবা বিনির্মাণের পরবর্তী কালে।”

অর্থাৎ নবি ইয়াকুব (আ.) হচ্ছেন বাইতুল মুকাদ্দাস মসজিদের সর্বপ্রথম গোড়াপত্তনকারী। তিনি ছিলেন নবি ইবরাহিম (আ.) এর নাতি। দাদা ও নাতির কাজের মাঝে ৪০ বছরের ব্যবধান থাকা খুবই সম্ভব। কাজেই হাদিসে কাবা ও আকসার মাঝে ৪০ বছরের ব্যবধানের তথ্যের সঙ্গে এই তথ্য পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ।

তার মানে এটা নিশ্চিত এই মসজিদ প্রথম সোলেমান (আঃ) তৈরি করেছেন এই ধারনাই ভুল বরং তিনি পূনরায় নির্মাণ করেছেন শুধু। তাই থার্ড টেম্পল বানানোর পরিকল্পনা ইসলামের শত্রুদের অযৌক্তিক যুক্তি।

মূলত ইয়াকুব (আঃ)-এর নাম বা উপাধি ছিল ইসরাঈল যার অর্থ আল্লাহর বান্দা। আর তার বংশধরকে বনী ইসরায়েল বলা হতো। তার একপুত্রের নাম ধারণামতে ইয়াহুদ ছিল। তার নামে বনী ইসরায়েলরা কিছু নিয়মনীতি চালু করে ও নিজেদের মুসলিম নাম বাদ দিয়ে ইয়াহুদী নামে পরিচিত করে। ইয়াহুদী বা ইহুদী মূলত বংশীয় পরিচয় এবং পরে ধর্মীয় পরিচয় লাভ করে। বর্তমান সিরিয়া, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, জর্ডান, লেবাননকে বলা হতো শাম যা নূহ (আঃ)-এর ছেলের নাম।

ইয়াকুব (আঃ)-এর বংশধরগণ বা বনী ইসরায়েলীরা ইউসুফ (আঃ)-এর সময় শাম হতে মিশরে এসে বসবাস শুরু করে।
পরবর্তীতে দ্বীন হতে দূরে সরে গেলে আল্লাহ মুসাকে (আঃ) পাঠান। তাই মুসার (আঃ) সাথে যারা হিজরত করেছিল তারাও ছিল বনী ইসরায়েল।

তাই কুরআনে মুসার (আঃ) জাতির ক্ষেত্রে বনী ইসরায়েল যেমন বলা হয়েছে তেমনি পরবর্তীতেও বলা হয়েছে। যাদের অনেকে মুসলিম হয়েছিলেন। অর্থাৎ বিশ্বের যে প্রান্তে ইয়াহুদী থাক তার পরিচয় ইয়াহুদী বা ইহুদী তা কোন নির্দিষ্ট দেশ বা ভূখন্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ না।

মুসার (আঃ) জাতি জেরুজালেমে ফিরে যেতে পারেনি কারণ তারা জেহাদ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে তারা খোলা প্রান্তরে শরণার্থীর মত ঘুরে বেড়ায়। পরবর্তীতে মুসার (আঃ) দাওয়াতের বদৌলতে নতুন প্রজন্ম জেগে উঠে। তার মৃত্যুর পর ইউশা ইবনে নুন নবী হন। তার নেতৃত্বে আল্লাহ মুসলিমদের পবিত্রভূমিতে ফিরিয়ে আনেন এবং জেহাদের সময় আল্লাহ সূর্যের গতি থামিয়ে অলৌকিকভাবে সাহায্য করেন।

● আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘… তারা অভিযান পরিচালনা করল, তারা আসরের সময় বা তার নিকটবর্তী সময়ে জনপদের নিকটবর্তী হলো। তিনি (ইউশা ইবনে নুন) সূর্যের উদ্দেশ্যে বললেন, নিশ্চয়ই তুমি আদিষ্ট এবং আমি আদিষ্ট। হে আল্লাহ! আপনি একে (সূর্য) আমাদের ওপর স্থির রাখুন। তাকে স্থির রাখা হলো যতক্ষণ না আল্লাহ তাদের বিজয় দান করেছিলেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩১২৪)।

কিন্তু বনী ইসরায়েল জাতি আবার দ্বীন হতে দূরে সরে যায় অথচ আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইব্রাহিম (আঃ) এর বংশধরকে নেতৃত্ব দিবেন। তাই ইব্রাহিম (আঃ) এর অপর সন্তান ইসমাঈল (আঃ) এর বংশধরের কাছে নেতৃত্ব চলে আসে ও কেবলাহ মক্কায় ফিরে আসে।

রসুল (সাঃ) ও কোরাইশগণ ঈসমাইল (আঃ) এর বংশধর। রসুল (সাঃ) এর দাওয়াত ও জেহাদের বদৌলতে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে। সে সুবাদেই উমর (রাঃ) এর যুগে মুসলিমরা তা বিজয় করে। পরবর্তীতে নূরউদ্দিন জঙ্গি (রহঃ) এর দাওয়াত ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার বদৌলতে সালাউদ্দিন আইয়ুবী (রহঃ) জেহাদের মাধ্যমে তা উদ্ধার করে।

যতবারই মুসলিমরা ইসলাম, ইসলামি শাসন ও জেহাদের সুন্নাহ হতে দূরে সরে গেছে ততবারই জেরুজালেম, আল কুদস তাদের হাতছাড়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও জেহাদের মাধ্যমেই জেরুজালেম বিজয় হবে।

● আবদুল্লাহ ইবনে হারিস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “পূর্বদিক (খোরাসান) থেকে কিছু লোক বের হয়ে আসবে, যারা ইমাম মাহদির খিলাফত প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে এবং খিলাফত প্রতিষ্ঠা সহজ করে দিবে।” (সুনানে ইবনে মাজা, খণ্ড ৩, হাদিস নং ৪০৮৮)

● হযরত ছওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখন তোমরা দেখবে, কালো পতাকাগুলো খোরাসানের দিক থেকে এসেছে, তখন তাদের সাথে যুক্ত হয়ে যেও। কেননা, তাদেরই মাঝে আল্লাহর খলীফা মাহদি থাকবে।” (মুসনাদে আহমাদ, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৭৭; কানজুল উম্মাল, খণ্ড ১৪, পৃষ্ঠা ২৪৬; মিশকাত শরীফ, কেয়ামতের আলামত অধ্যায়)।

● হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, একদা আমরা নবী করীম (সাঃ) এর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উনি বলতে ছিলেন, “ঐ দিক থেকে একটি দল আসবে (হাত দিয়ে তিনি পূর্ব দিকে ইশারা করলেন)। তারা কালো পতাকাবাহী হবে। তারা সত্যের (পূর্ণ ইসলামী শাসনের) দাবী জানাবে, কিন্তু তাদেরকে দেওয়া হবে না। দুইবার বা তিনবার এভাবে দাবী জানাবে, কিন্তু তখনকার শাসকগণ তা গ্রহণ করবে না। শেষ পর্যন্ত তারা (ইসলামী শাসন ব্যবস্থার দায়িত্ব) আমার পরিবারস্থ একজন লোকের (ইমাম মাহদির) হাতে সোপর্দ করে দিবে। সে জমিনকে ন্যায় এবং নিষ্ঠার মাধ্যমে ভরে দিবে, ঠিক যেমন ইতিপূর্বে অন্যায় অত্যাচারের মাধ্যমে ভরে দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যদি কেউ ঐ সময় জীবিত থাকো, তবে অবশ্যই তাদের দলে এসে শরীক হয়ে যেও – যদিও বরফের উপর কনুইয়ে ভর দিয়ে আসতে হয়।” (আবু আ’মর আদ দাইনিঃ ৫৪৭, মুহাক্কিক আবু আবদুল্লাহ শাফেয়ী হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন)।

কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার হল কেন প্রতি রমাদ্বানে বিশ্বের অনেক স্হানে মসজিদ ও মুসলিমদের উপর নির্যাতন শুরু হয়? কারণ জানতে হলে ওদের ষড়যন্ত্র বুঝতে হবে-
হিজরী দ্বিতীয় সনের রজব মাসে রাসূল (সা) আটজন সাহাবীর একটি দলকে নির্বাচন করলেন। এই আট জনের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ (রাঃ) ও সাদ ইবন আবী ওয়াক্কাসও ছিলেন।
রাসূল (সা) সকলকে সম্বোধন করে বললেন, তোমাদের মধ্যে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় যে সর্বাধিক সহনশীল তাঁকেই তোমাদের আমীর বানাবো। অতঃপর আবদুল্লাহকে (রাঃ) তিনি আমীর মনোনীত করলেন। রাসূল (সা) তাঁকে যাত্রাপথ নির্দেশ করে তাঁর হাতে একটি সীল মোহর অঙ্কিত চিঠি দিয়ে বললেন, ‘দুই দিনের আগে এই চিঠিটি খুলবে না। দুইদিন পথ চলার পর খুলে পড়বে এবং এই চিঠির নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করবে।’

হযরত আবদুল্লাহ তাঁর সাথীদের নিয়ে মদীনা থেকে রওয়ানা হলেন। দুইদিন পথ চলার পর নির্দেশ মত চিঠিটি খুলে পড়লেন। চিঠিতে নির্দেশ ছিল, মক্কা ও তায়েফের মাঝখানে নাখলা নামক স্থানে পৌছে কুরাইশদের গতিবিধি ও অন্যান্য অবস্থা অবগত হবে। তিনি অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে এ হুকুম মাথা পেতে নিলেন।
সঙ্গীদের সম্বোধন করে তিনি বললেন, ‘বন্ধুগণ, আমি রাসূলুল্লাহর (সা) এ আদেশ কার্যকরী করে ছাড়বো। তোমাদের মধ্যে যে শাহাদাতের অভিলাষী সে আমার সাথে যেতে পারে, এবং যে তা পছন্দ না কর ফিরে যেতে পার। আমি কাউকে বাধ্য করবো না।’ এ ভাষণ শুনে সকলে তাঁর সঙ্গী হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। নাখলা পৌঁছে তাঁরা কুরাইশদের গতিবিধির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতে লাগলেন। একদিন কুরাইশদের একটি বাণিজ্য কাফিলা এই পথ দিয়ে অতিক্রম করছিল। এই কাফিলায় ছিল চার ব্যক্তি। ‘আমর ইবনুল হাদরামী, হাকাম ইবন কায়সান, উসমান ইবন আবদিল্লাহ এবং উসমানের ভাই মুগীরা। যারা ইসলামের বড় শত্রু ছিল।

কাফিলাটি আক্রমণ করা না করা বিষয়ে আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ তাঁর সঙ্গীদের সাথে পরামর্শ করলেন। সেই দিনটি ছিল হারাম মাসসমূহের সর্বশেষ দিন। উল্লেখ্য যে, জুল কা’দা, জুল হিজ্জা, মুহাররম ও রজব- এ চারটি মাস হচ্ছে হারাম মাস।
প্রচীন কাল থেকে আরবরা এ মাসগুলিতে যুদ্ধবিগ্রহ ও খুন-খারাবী নিষিদ্ধ বলে মনে করতো। তাঁরা ভেবে দেখলেন, একদিকে আজ কাফিলাটি আক্রমণ করলে হারাম মাসে তা করা হবে। অন্যদিকে আজ আক্রমণ না করে আগামীকাল করলে কাফিলাটি মক্কার হারামের আওতায় পৌঁছে যাবে।
মক্কার হারাম সকলের জন্য নিরাপদ স্থান। সেখানে তাদের আক্রমণ করলে হারাম কাজ করা হবে। পরামর্শের পর তারা আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তাঁরা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে কাফিলার নেতা ‘আমর ইবনুল হাদরামীকে হত্যা, উসমান ইবন আবদিল্লাহ ও হাকাম ইবন কায়সানকে বন্দী করেন এবং অন্যজন পালিয়ে যায়।
তাঁরা প্রচুর পণ্যসামগ্রী গনীমাত হিসাবে লাভ করেন। আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ অর্জিত গনীমাতের এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য রেখে দিয়ে অবশিষ্ট চার ভাগ তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে সমানভাবে বন্টন করে দেন। তখনও গনীমাত বন্টনের কোন নিয়ম-নীতি নির্ধারণ হয়নি। তবে আবদুল্লাহর এই ইজতিহাদ সঠিক হয়েছিল। পরে তাঁর এই সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে কুরআনে ‘খুমুস’ (পঞ্চমাংশ) –এর আয়াত নাযিল হয়।

হযরত আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ গনীমাতের এক পঞ্চমাংশ নিয়ে মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সা) খিদমতে হাজির হলেন। রাসূল (সা) তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। তিনি বললেন, আমি তো তোমাকে ‘হারাম’ বা নিষিদ্ধ মাসে রক্তপাতের নির্দেশ দিইনি।

আবদুল্লাহ (রাঃ) এর এই দুঃসাহসের জন্য অন্য মুসলিমরাও তাঁর নিন্দা করলেন। কুরাইশরাও এই ঘটনাকে খুব ফলাও করে প্রচার করতে লাগলো। তারা বলে বেড়াতে লাগলো, মুহাম্মাদের (সা) এর সাহাবীরা হারাম মাসগুলিকে হালাল বানিয়ে নিয়েছে।
হত্যা ও রক্ত ঝরিয়ে তারা এই মাসগুলির অবমাননা করেছে। হযরত আবদুল্লাহ ও তাঁর সাথীরা ভীষণ বিপদে পড়লেন। রাসূল্লাহর (সা) অবাধ্যতা হয়েছে এই ভয়ে তাঁরা ভীত হয়ে পড়লেন। তাঁরা অনুশোচনায় জর্জরিত হতে লাগলেন।
অবশেষে আল্লাহ তা’আলা তাদের কাজে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে কুরআনের এই আয়াতটি নাযিল করলেনঃ

‘হারাম (নিষিদ্ধ) মাস সম্পর্কে তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে যে, সে মাসে যুদ্ধ করা কি জায়েয? আপনি বলে দিন, এই মাসে যুদ্ধ করা বড় ধরনের অপরাধ। আর আল্লাহর রাস্তায় বাধা দেওয়া, তাঁকে অস্বীকার করা, মসজিদে হারাম (কা’বা) থেকে বিরত রাখা এবং তার অধিবাসীদের সেখান থেকে বিতাড়িত করা আল্লাহর কাছে তার থেকেও বড় অপরাধ। আর ফিতনা বা বিপর্যয় সৃষ্টি করা হত্যা অপেক্ষাও খারাপ কাজ।’

আল বাকারাহ-২১৭

কুরআনের এ আয়াত নাযিলের পর তাঁরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মুসলমানরা দলে দলে তাঁদের অভিনন্দন জানালেন এবং তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। রাসূল (সা) তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন, তাদের নিকট থেকে গনীমাতের অংশ গ্রহণ করলেন এবং মুক্তিপণ গ্রহণ করে বন্দী দু’জনকে মুক্তি দিলেন।

সবাই জানে রমাদান পবিত্র মাস। ওরা চায় এই মাসে মসজিদ ও মুসলিমদের আঘাত করতে এজন্যই যে মুসলিমরা কেউ যদি পাল্টা আঘাত হানে তারা ও মডারেট মুসলিমরা প্রচার করবে ওরা উগ্রবাদী, বিশ্বশান্তির পথে বাধা। যেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে সবাই এসব মুসলিমদের বয়কট ও কঠোর ব্যবস্হা নিতে পারে। এজন্য তাদের দোসররা বহু হাদীসের ভুল ব্যাখা করে।

● মুসলিম শরীফে আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত হবে না, যতক্ষণ না মুসলমানেরা ইহুদিদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। অতঃপর মুসলমানগণ ইহুদিরকে হত্যা করবে। ইহুদিরা গাছ ও পাথরের আড়ালে পালাতে চেষ্টা করবে। কিন্তু কেউ তাদেরকে আশ্রয় দিবে না। গাছ বা পাথর বলবে, হে মুসলমান! হে আল্লাহর বান্দা! আমার পেছনে একজন ইহুদি লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা করো। তবে ‘গারকাদ’ নামক গাছের পেছনে লুকালে গারকাদ গাছ কোন কথা বলবে না। এটি ইহুদিদের গাছ বলে পরিচিত। (কেয়ামতের ফেতনা অধ্যায়)।

ওরা এভাবে প্রচার করে মুসলিমদের দ্বীন কত ভয়ানক যে আমাদের সমূলে হত্যা করতে বলে তাই ভবিষ্যতে মুসলিমরা এই পরিকল্পনা করবে!! ওরা শান্তির পথে বড় শত্রু। কিন্তু হাদীসের পটভূমি বুঝতে হবে- ইসলাম কখনও বলে না সমূলে কোন জাতিকে ধ্বংস করতে। এই হাদীসটা প্রযোজ্য হবে যা ঈসা (আঃ) এর পরবর্তীতে দাজ্জালের অনুসারী ইহুদিদের ক্ষেত্রে। কারণ তখন প্রকৃত মাসীহ ঈসা (আঃ) চলে আসবেন তাই সত্য-মিথ্যা সুস্পষ্ট। তাই তখন মিথ্যা মাসীহ বা রব দাবীদার দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ করা স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমানে ইরানের ইহুদিদের সাথে মুসলিমদের কোন সংঘাতই চলছে না। মূলত ইসরায়েলের ইহুদিরা বিশ্বাস করে – জেরুজালেম দখল করলে ওদের মাসীহ এসে রাজত্ব করবে।

অপরদিকে ইরানের ইহুদিরা বিশ্বাস করে মাসীহ বা দাজ্জাল এসে ওদের জেরুজালেমে ফিরিয়ে নিবে। তাই যখন খোরাসান বাহিনী ওদের পরিকল্পনা শেষ করে দিবে বা জেরুজালেম বিজয় করবে তখন তারা মাসীহ বা দাজ্জালের অপেক্ষায় থাকবে। দাজ্জাল এলে জেরুজালেমমুখী হবে তখন আল্লাহ ঈসাকে (আঃ) পাঠিয়ে রক্ষা করবেন।

● আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘দাজ্জালের অনুসরণ করবে ইস্পাহানের ৭০ হাজার ইয়াহুদি; যাদের উপর লম্বা চাদর থাকবে।’ (মুসলিম)।

● হাদীসে বর্নিত হয়েছে – একদা ঈসা আলাইহিস সালাম বলবেনঃ (বাইতুল মাক্বদিসের) দরজা খোলো। তখন দরজা খোলা হবে। তার পেছনে থাকবে দাজ্জাল এবং দাজ্জালের সাথে থাকবে সত্তর হাজার ইহুদি। তাদের প্রত্যেকেই থাকবে তলোয়ারধারী এবং মোটা চাদর পরিহিত। দাজ্জাল যখন ইসা আলাইহিস সালাম কে দেখবে তখনই সে চুপসে বা গলে যাবে যেমনভাবে গলে যায় পানিতে লবণ এবং সে ভাগতে শুরু করবে। তখন তিনি বলবেনঃ তোমার জন্য আমার পক্ষ থেকে একটি কঠিন মার রয়েছে যা তুমি কখনো এড়াতে পারবে না। অতঃপর ইসা আলাইহিস সালাম তাকে পূর্ব দিকের লুদ্দ নামক গেইটের পাশেই হত্যা করবেন। আর তখনই ইয়াহুদিরা পরাজিত হবে। এ দুনিয়াতে আল্লাহ তাআলার যে কোন সৃষ্টির পিছনে কোন ইয়াহুদি লুকিয়ে থাকলে আল্লাহ তাআলা সে বস্তুকে কথা বলার শক্তি দিবেন এবং বস্তটি তার সম্পর্কে মুসলমানদেরকে বলে দিবে। চাই তা পাথর, গাছ, দেয়াল কিংবা যে কোন পশুই হোক না কেন। কিন্তু গারক্বদ নামক গাছটি। সে তো তাদেরই গাছ। তাই সে তাদের ব্যাপারে মুসলমানদেরকে কিছুই বলবে না”। (ইবনু মাজাহ হাদীস নং-৪০৭৭)।

পবিত্রভূমি রক্ষা আল্লাহই করবেন – যারা ইসলামের পথে থাকবে তাদের হাতে বিজয় দিবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *