ছোটবেলা হতে সর্প, সাপ যাই বলুক না কেন আমার সাথে বিষ মধুর সম্পর্ক। সিলেট, রাঙ্গামাটির পাহাড়ী এলাকা হতে শুরু করে আমার বাড়ির আশ-পাশ, জুতার ভিতর, জানালা-দরজার দ্বার এমনকি কিছু সাপ আমার বিছানায় উঠে আসত। সবাই যখন উজানী মাছ পেত (বিদ্যুৎ চমকালে কই মাছ পানি ছেড়ে উপরে উঠে আসে) আমার সাথে সাপের সাক্ষাৎ হতো।
একবার এক সাপের আদর আলিঙ্গনে (কামড়) ঢাকা মেডিকেল পর্যন্ত যেতে হয়েছিল।
দেশ ছেড়ে বিদেশে এলাম, সেখানেও মেইন রাস্তায় সাপের দেখা মিলে। একদিন রাস্তায় হাটছিলাম, হঠাৎ এক বৃদ্ধ মহিলা আতংকে ডেকে বলল- সাপ!! দেখলাম ছোট সাপ। মহিলা বলল- মেরে ফেল! আমি বললাম ছোট সাপ একটু রোদ পেয়ে পাথুরে গর্ত ছেড়ে রাস্তায় এসেছে, তেমন বিষ নাই। মহিলার ভয় কমলো না, মেরে ফেলার অনুরোধ করলো, আমি বললাম অবুঝ প্রাণী (সাপ) ভুলে নিজ সীমানা ছেড়ে চলে এসেছে আবার ফিরে যাবে গর্তে।
মহিলা অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, একটু দূরে চলে গেল, কিছুক্ষন পর সাপটাও চলে গেল।
আসলে মানুষ কত অদ্ভুত!! সামান্য সাপের বিষের ভয় করে অথচ জাহান্নামের ভয় ভুলে যায়। অথচ অনেক মানুষের চরিত্র নিকৃষ্ট অথচ সাপটাকে বেশি ঘৃনা, ভয় করে। সাপ যখন তার সীমানা (গর্ত, জঙ্গল) ছেড়ে মানুষের সীমানায় প্রবেশ করে যতক্ষণ না গর্তে ফেরত যায় বা মেরে ফেলা হয় মানুষ আতংক মুক্ত হয় না কারন যেকোন সময় যে কারো শরীরে সর্প দংশনে বিষ প্রবেশ করতে পারে। ঠিক তেমনি আমরা যখন কাফের, মুশিরক, মুনাফেকের সাথে যদি অতি ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখি যেকোন সময় আমাদের মাঝে শিরকসহ অন্যান্যা পাপ প্রবেশ করতে পারে। তাই সম্পর্কের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সীমারেখা বজায় রাখা উচিত।
আল্লাহ বলেন-
“মুমিনগণ! তোমরা ইয়াহুদী ও নাসারাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহন করলে সে নিশ্চয় তাদেরই একজন। নিশ্চয় আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না।”
সুরা আল ইমরান
কারন তারা আল্লাহর নির্ধারিত সীমানা (হালাল-হারাম) ছেড়ে শিরক (রুবুবিয়্যাতের সীমানায় প্রবেশ করছে) করে চলছে।
অথচ সাপ বা অন্য প্রানীরা মানুষের ভাষা ও সীমানা বুঝে না, না তাদের জন্য তাদের ভাষায় কিতাব নাযিল হয়েছে, যেখানে মানুষ তাদের সীমারেখা বুঝিয়ে দিয়েছে। অথচ আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রসুলগন ও কিতাব পাঠিয়ে আমাদের দায়িত্ব ও হালাল হারামের সীমানা প্রাচীর জানিয়ে দিয়েছেন।
আল্লাহ বলেন,
‘আমি কোনো নবীই এমন পাঠাইনি, যে (নবী) তার জাতির (মাতৃ) ভাষায় (আমার বাণী তাদের কাছে পৌঁছায়নি), যাতে করে সে তাদের কাছে (আমার আয়াত) পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলতে পারে।’
সুরা ইব্রাহিম, আয়াত ৪
কুরআনে আরো বর্নিত –
‘আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যে এ মর্মে রাসুল পাঠিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো ও তাগুত বর্জন করো…।’
সুরা নাহল, আয়াত ৩৬
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং উত্তম পন্থায় জীবিকা অন্বেষণ কর। যা হালাল তাই গ্রহণ কর এবং যা হারাম তা বর্জন কর।’ (ইবনে মাজা : ২১৪৪)
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
‘হে মুমিনরা! আল্লাহ তোমাদের জন্য যেসব উৎকৃষ্ট বস্তু হালাল করেছেন তা তোমরা হারাম কোরো না এবং সীমা লঙ্ঘন কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না।’
সুরা মায়িদা, আয়াত : ৮৭
অথচ বহু হালাল বিধান (জেহাদ, দাড়ি রাখা) প্রত্যক্ষ, পরোক্ষভাবে হারাম ভাবছে বা অপছন্দ করছে।
আর প্রতিটি প্রানী আল্লাহর জিকির করে তা সে যত হিংস্রাত্মক, বিষাক্ত হোক না কেন।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
‘সাত আকাশ, পৃথিবী ও এগুলোর মধ্যে যা কিছু আছে, সব কিছুই তাঁর (আল্লাহর) পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। আর এমন কিছু নেই, যা তাঁর প্রশংসা, পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না। কিন্তু তোমরা তাদের পবিত্রতা ও মহিমাকীর্তন বুঝতে পারো না। অবশ্যই তিনি সহিষ্ণু, ক্ষমাশীল।’
সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত ৪৪
আরও বর্নিত হয়েছে –
‘তুমি কি দেখোনি যে আসমান ও জমিনে যারা আছে তারা এবং সারিবদ্ধ হয়ে উড়ন্ত পাখিরা আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করে? প্রত্যেকেই তাঁর সালাত ও তাসবিহ জানে। তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবগত।’
সুরা নূর, আয়াত ৪১
“আমি তো তোমাকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সর্তককারীরূপে প্রেরণ করেছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা উপলব্ধি করে না।” (সূরা সাবা-২৮)
বজ্র সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,
‘আর বজ্র তার সপ্রশংস তাসবিহ পাঠ করে।’
সুরা রাদ, আয়াত ১৩
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা.) থেকে বর্ণিত, বজ্রধ্বনি শুনতে পেলে আলাপ-আলোচনা বন্ধ করে দিয়ে বলতেন, ‘মহাপবিত্র সেই সত্তা বজ্রধ্বনি যাঁর প্রশংসাসহ পবিত্রতা ঘোষণা করে এবং ফেরেশতাকুল যার ভয়ে শঙ্কিত।’ অতঃপর তিনি বলতেন, এটা হলো জগত্বাসীর জন্য চরম ভীতি প্রদর্শন বা হুমকি। (আদবুল মুফরাদ, হাদিস : ৭২৮)
অথচ কুরআনে অনেক মানুষকে পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট বলা হয়েছে!!
কুরআনে বর্নিত –
‘তারা (মানুষ হয়েও) পশুর মতো, বরং পশুর চেয়েও বেশি নিকৃষ্ট’
সুরা আরাফ, আয়াত ১৭৯
তারা কারা জানেন কি!! পশু, জন্তু, সাপ যত হিংস্র বিষাক্ত হোক না কেন আল্লাহর প্রশংসা করে চলেছে তারা শিরকমুক্ত। একমাত্র মানুষ, জ্বিন আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজের নফস বা অন্যকিছুকে ইলাহ মেনে চলেছে।
আল্লাহ বলেন-
“আপনি কি সে ব্যক্তিকে দেখেছেন যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে।”
সুরা জাসিয়াহ, আয়াত ২৩
এ জাতীয় লোকদের ব্যাপারে আল্লাহর বক্তব্য হচ্ছে,
‘‘আল্লাহর হেদায়াত ব্যতীত যারা নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তাদের চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে।’’
সুরা কাসাস, আয়ত ৫০
তার মানে যে বা যারা আল্লাহর কিতাব যতবেশি মেনে চলে সেই ততবেশি উৎকৃষ্ট তারাই মুমিন, মুসলিম। আর যারা আল্লাহর কিতাব না মেনে নিজের খেয়াল-খুশি, অন্য কারো শিরকী নিয়মনীতি মেনে চলে তারাই নিকৃষ্ট।
আল্লাহ বলেন-
“আপনি বলুন, হে আহলে কিতাবগণ! এস সে কথায়, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই; যেন আমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত না করি, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক না করি এবং আমাদের কেউ আল্লাহ ছাড়া একে অন্যকে রব হিসেবে গ্রহণ না করি। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তোমরা বল, তোমরা সাক্ষী থাক যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম।”
সুরা আল ইমরান, আয়াত ৬৪
দাউদ শরীফের হাদীসে এভাবে এসেছে যে, একবার কিছু লোক হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে হুজুর (সাঃ)-এর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু বলার জন্য আরজ করলেন। জওয়াবে মা আয়েশা (রাঃ) তাদের জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি কুরআন পড় নাই? রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চরিত্র ছিল জীবন্ত কুরআন।”
এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন,
“নিশ্চয়ই আপনি এক মহান চরিত্রের অধিকারী।”
সূরা ক্বালাম, আয়াত ৪
“হে মুহাম্মদ! (সা:) আমি তোমাকে সমগ্র জগতের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।”
সূরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৭
কুরআনে আরও বর্নিত আছে,
“যে লোক আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত, সে কি ঐ লোকের সমান হতে পারে, যে আল্লাহর রোষ অর্জন করেছে? বস্তুতঃ তার ঠিকানা হল দোযখ। আর তা কতইনা নিকৃষ্ট অবস্থান! আল্লাহর নিকট মানুষের মর্যাদা বিভিন্ন স্তরের আর আল্লাহ দেখেন যা কিছু তারা করে।”
সুরা আল ইমরান, আয়াত ১৬২ -১৬৩
আমাদের শরীয়তে সম্পূর্ণ নিখুঁত সাপ নিধনের সুন্দর বিধান দেওয়া আছে –
মুহাম্মাদ ইবনু মুসান্না (রহঃ) … নাফি (রহঃ) খবর দিয়েছেন, যে, আবূ লূবাবা ইবনু আবদুল মুনযির আনসারী (রাঃ) তাঁর বাসস্থান ছিল কুবায়। তিনি মদিনায় (মসজিদে নববীর কাছে) স্থানান্তরিত হলেন এমন অবস্থায় যে, আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) তাঁর [আবূ লূবাবা (রাঃ)] এর সাথে বসা ছিলেন এবং তাঁর জন্য একটি ছোট দরজা খুলছিলেন। তখন হঠাৎ তাঁরা বাড়ি-ঘরে বসবাসকারী প্রকৃতির একটি সাপ দেখতে পেলেন। তারা সেটিকে মেরে ফেলতে উদ্যত হলে আবূ লুবাবা (রাঃ) বললেন, ওগুলো নিধন করতে নিষেধ করা হয়েছে। তিনি (ওগুলো বলে) বাড়ি-ঘরে বসবাসকারী সাপ বুঝাতে চেয়েছেন। আর লেজ খসা ও পিঠে দুটি সাদা রেখাবিশিষ্ট সাপ মেরে ফেলার হুকুম দিয়েছেন। বলা হয়েছে যে, সে দুটি হল এমন, যারা দৃষ্টিশক্তি ঝলসিয়ে দেয় এবং মহিলাদের গর্ভপাত ঘটায়। (সহীহ মুসলিম, সাপ নিধন অধ্যায়)
বর্তমানে মানুষ জানে -Spitting cobra দূর হতে থু থু মারতে পারে যে বিষে সাময়িক অন্ধ হতে পারে। এছাড়া অনেক জিন সাপের ছদ্মবেশে থাকে। হয়তো তারা ক্ষতি করতে পারে। নিশ্চয়ই আল্লাহ উত্তম জানেন।
একদা আবুস সায়েব আবূ সাঈদ খুদরী (রা) এর নিকট তাঁর বাড়িতে গেলেন। দেখলেন, তিনি স্বলাত পড়ছেন। তিনি বলেন, আমি তাঁর স্বলাত শেষ হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম। ইত্যবসরে বাড়ির এক প্রান্তে (ছাদে লাগানো) খেজুর কাদির ডালগুলিতে কিছু নড়া-সরা করার শব্দ শুনতে পেলাম। দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখি, একটি সাপ। আমি লাফিয়ে উঠে তা মারতে উদ্যত হলাম। কিন্তু তিনি আমাকে ইশারা করে বললেন, ‘বসে যাও।’ সুতরাং আমি বসে গেলাম। অতঃপর স্বলাত শেষ হলে তিনি আমাকে বাড়ির ভিতরে একটা ঘর দেখিয়ে বললেন, ‘এ ঘরটা দেখছ?’ আমি বললাম, ‘জী।’ তিনি বললেন, ‘এ ঘরে আমাদেরই একজন নব্য বিবাহিত যুবক ছিল। আমরা রসূলুল্লাহ (সা) এর সাথে খন্দকের প্রতি বের হয়েছিলাম। সেই যুবক দুপুরে রসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট অনুমতি নিয়ে নিজ বাসায় ফিরত আসে। সে একদিন তাঁর নিকট অনুমতি নিল। তিনি বললেন, “তুমি তোমার অস্ত্র সঙ্গে নাও। তোমার প্রতি কুরাইযার আশঙ্কা হয়।”
সুতরাং সে নিজ অস্ত্র নিয়ে বাসায় ফিরল। দেখল তার (নতুন) বউ দরজার দুই চৌকাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। সে ঈর্ষান্বিত হয়ে বর্শা তুলে তাকে আঘাত করত উদ্যত হল! তার স্ত্রী তাকে বলল, ‘আপনি আপনার বর্শা নিবারণ করুন। বাসায় প্রবেশ করুন, তাহলে দেখতে পাবেন, কে আমাকে বের করেছে?
সুতরাং সে বাসায় প্রবেশ করে দেখল, একটি বৃহদাকার সাপ বিছানায় কুন্ডলী পাকিয়ে বসে আছে! অতএব সে বর্শা দিয়ে আঘাত করে তাকে গেঁথে ফেলল। অতঃপর কক্ষ থেকে বের হয়ে বাড়ির (মাটিতে) বর্শাটিকে গেড়ে দিল। তৎক্ষণাৎ সাপটি ছট্ফট্ করে লাফিয়ে উঠে তার উপর হামলা করল অতঃপর জানা গেল না যে, কে আগে সত্বর মারা গেল; সাপটি, নাকি যুবকটি?
আমরা রসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট গিয়ে এ ঘটনা বর্ণনা করলাম এবং বললাম, ‘আপনি আল্লাহর কাছে দু’আ করুন, যাতে তিনি ওকে বাঁচিয়ে তোলেন।’ তিনি বললেন, “তোমরা তোমাদের সঙ্গীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর।” অতঃপর বললেন, “অবশ্যই মদীনায় কিছু জ্বিন আছে, যারা মুসলমান হয়েছে। সুতরাং তাদের কাউকে (সর্পাকারে) দেখলে তাকে তিন দিন সতর্ক কর। অতঃপর উচিত মনে হলে তাকে হত্যা কর। কারণ সে শয়তান। (মুসলিম)।