কারবালার পথে পর্ব-২ (খেলাফত ও রাজতন্ত্র)

বেশিরভাগ আলেমই কারবালার আলোচনা করে ইতিহাস হতে বা উসমান (রা:) এর শাহাদাতের পর হতে। অথচ ফেতনার দরজা হল উমর (রা:), তার শাহাদাতের পরই ফেতনা শুরু।

হুযাইফা (রা) বলেন, একবার আমরা উমার (রাঃ)-এর নিকট উপবিষ্ট ছিলাম। হঠাৎ তিনি বললেন, ফিত্‌না সম্পর্কে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বক্তব্য তোমাদের মধ্যে কে স্মরণ রেখেছে? হুযাইফা (রাঃ) বললেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন মানুষ নিজের পরিবার, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি ও প্রতিবেশীর ব্যাপারে যে ফিত্‌নায় পতিত হয়, সালাত, সদাকাহ, সৎকাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ তার সে পাপকে মুছে ফেলে। তিনি বলেন, আমি তোমাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করিনি, এবং সে ফিত্‌নার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছি যা সাগর লহরীর মত ঢেউ খেলবে। হুযাইফাহ (রাঃ) বললেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! সে ফিত্‌নায় আপনার কোন অসুবিধা হবে না। কেননা, সে ফিত্‌না ও আপনার মাঝে একটি বন্ধ দরজা আছে। উমার (রাঃ) বললেন, দরজাটি কি ভেঙ্গে ফেলা হবে, না খুলে দেওয়া হবে? তিনি বললেন, না বরং ভেঙ্গে ফেলা হবে। ‘উমার (রাঃ) বললেন, তা হলে তো সেটা আর কখনো বন্ধ করা যাবে না। (হুযাইফাহ বলেন) আমি বললাম হ্যাঁ। (শাকীক বলেন) আমরা হুযাইফা (রাঃ) – কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘উমার (রাঃ) কি দরজাটি সম্পর্কে জানতেন? উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ। যেমন আমি সুনিশ্চিতভাবে জানি যে আগামী দিনের পর রাত আসবে।
কেননা আমি তাকে এমন হাদীস বর্ণনা করেছিলাম যা ত্রুটিমুক্ত। (শাকীক বলেন) দরজাটি কে সম্পর্কে আমরা হুযাইফাহ (রাঃ) – কে জিজ্ঞেস করতে আমরা ভয় পাচ্ছিলাম, তাই আমরা মাসরুককে জিজ্ঞেস করতে বললাম। তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, দরজাটি কে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘উমার (রাঃ) (নিজেই)। (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৬০১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৬১৫)

উমর (রা:) এর খেলাফতের সময়ের ঘটনা

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি মুহাজিরদের কতক লোককে পড়াতাম। তাঁদের মধ্যে আবদুর রহমান ইবনু আওফ (রাঃ) অন্যতম ছিলেন। একবার আমি তাঁর মিনার বাড়িতে ছিলাম। তখন তিনি উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ) এর সঙ্গে তাঁর সর্বশেষ হজ্বে রয়েছেন।
এমন সময় আবদুর রহমান (রাঃ) আমার কাছে ফিরে এসে বললেন, যদি আপনি ঐ লোকটিকে দেখতেন, যে লোকটি আজ আমীরুল মু’মিনীন-এর কাছে এসেছিল এবং বলেছিল, হে আমীরুল মু’মিনীন! অমুক ব্যক্তির ব্যাপারে আপনার কিছু করার আছে কি যে লোকটি বলে থাকে যে, যদি উমার মারা যান তাহলে অবশ্যই অমুকের হাতে বায়আত করব। আল্লাহর কসম! আবূ বকরের বায়আত আকস্মিক ব্যাপার-ই ছিল। ফলে তা হয়ে যায়। এ কথা শুনে তিনি ভীষণভাবে রাগান্বিত হলেন। তারপর বললেন, ইনশাআল্লাহ সন্ধ্যায় আমি অবশ্যই লোকদের মধ্যে দাঁড়াব আর তাদেরকে ঐসব লোক থেকে সতর্ক করে দিব, যারা তাদের বিষয়াদি আত্মসাৎ করতে চায়। আবদুর রহমান (রাঃ) বলেন, তখন আমি বললাম, হে আমীরুল মু’মিনীন! আপনি এমনটা করবেন না। কারণ, হজ্জের মওসুম নিম্নস্তরের ও নির্বোধ লোকদেরকে একত্রিত করে। আর এরাই আপনার নৈকট্যের সুযোগে প্রাধান্য বিস্তার করে ফেলবে, যখন আপনি লোকদের মধ্যে দাঁড়াবেন। আমার ভয় হচ্ছে, আপনি যখন দাঁড়িয়ে কোন কথা বলবেন তখন তা সব জায়গায় তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়বে। আর তারা তা ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারবে না। আর সঠিক রাখতেও পারবে না। সুতরাং মাদীনায় পৌঁছা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। আর তা হল হিজরাত ও সুন্নাতের কেন্দ্রস্থল। ফলে সেখানে জ্ঞানী ও সুধীবর্গের সঙ্গে মিলিত হবেন। আর যা বলার তা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারবেন। জ্ঞানী ব্যক্তিরা আপনার কথাকে সঠিকভাবে বুঝতে পারবে ও সঠিক ব্যবহার করবে।

তখন উমার (রাঃ) বললেন, জেনে রেখো! আল্লাহর কসম! ইনশাআল্লাহ আমি মাদীনাহ্ পৌঁছার পর সর্বপ্রথম এ কাজটি নিয়ে ভাষণের জন্য দাঁড়াব।

এরপর উমর (রা:) আবুবকর (রা:) কিভাবে খলিফা নির্বাচিত হয়েছেন মজলিসে শুরা দ্বারা বর্ননা করেন।
এরপর উমার (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা সে সময়ের জরুরী বিষয়ের মধ্যে আবূ বকরের বায়আতের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছুকে মনে করিনি। আমাদের ভয় ছিল যে, যদি বায়আতের কাজ অসম্পন্ন থাকে, আর এ জাতি থেকে আলাদা হয়ে যাই তাহলে তারা আমাদের পরে তাদের কারো হাতে বায়আত করে নিতে পারে। তারপর হয়ত আমাদেরকে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের অনুসরণ করতে হত, না হয় তাদের বিরোধিতা করতে হত, ফলে তা মারাত্মক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াত। অতএব যে ব্যক্তি মুসলিমদের পরামর্শ ছাড়া কোন ব্যক্তির হাতে বায়’আত করবে তার অনুসরণ করা যাবে না। আর ঐ লোকেরও না, যে তার অনুসরণ করবে। কেননা উভয়েরই নিহত হওয়ার আশংকা আছে।
(সহিহ বুখারী: ৪৩৫৯ ও ৬৮৩০ হাদীসগুলো বড় হওয়ায় সংক্ষেপে মূল বক্তব্য দেওয়া হল আমাদের বায়াত ও বংশীয় শাসন পোস্টে পুরা হাদীস পাবেন)

পরবর্তীতে তাই ঘটে। উম্মাহর উপর রাজতন্ত্র চেপে বসে, যার প্রতিবাদ করায় হোসেইনকে (রা:) শাহাদাত বরন করতে হয়। কাদের মধ্যে ক্ষমতা বা নিজস্ব নেতা নির্বাচনের ইচ্ছে ছিল তা উমর (রা:) এর শাহাদাতের পর উসমান (রা:) এর সময় ফেতনা হিসেবে দেখা দেয়। যা পুরা উম্মাহের কাছে স্পষ্ট হয় হোসেন (রা:) এর শাহাদাতের পরই।

সাফীনাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ নবুওয়্যাতের ভিত্তিতে পরিচালিত খিলাফত ত্রিশ বছর অব্যাহত থাকবে। অতঃপর আল্লাহর যাকে ইচ্ছা রাজত্ব বা তাঁর রাজত্ব দান করবেন। সাঈদ (রহঃ) বলেন, আমাকে সাফীনাহ (রাঃ) বলেছেন, হিসেব করো, আবূ বকর (রাঃ) দুই বছর, ‘উমার (রাঃ) দশ বছর, ‘উসমান (রাঃ) বারো বছর ও আলী (রাঃ) এতো বছর খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেছেন। সাঈদ (রহঃ) বলেন, আমি সাফীনাহ (রাঃ) -কে বললাম, এরা ধারণা করে যে, ‘আলী (রাঃ) খলীফাহ ছিলেন না। তিনি বলেন, বনী যারকা অর্থাৎ মাওয়ানের বংশধরগণ মিথ্যা বলেছে।

সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৬৪৬
হাদিসের মান: হাসান সহিহ

হাদিস হতে জানা যায় –
ইউসুফ ইব্‌ন্ধু মাহাক থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, মারওয়ান ছিলেন হিজাযের গভর্নর। তাকে নিয়োগ করেছিলেন মু’আবিয়াহ (রাঃ)। তিনি একদা খুতবা দিলেন এবং তাতে ইয়াযীদ ইবনু মুআবিয়ার কথা বারবার বলতে লাগলেন, যেন তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তার বায়’আত গ্রহণ করা হয়। এ সময় তাকে ‘আবদুর রহমান ইবনু আবু বকর কিছু কথা বললেন। মারওয়ান বললেন, তাঁকে পাকড়াও কর। তৎক্ষণাৎ তিনি আয়িশাহ (রাঃ)-এর ঘরে চলে গেলেন। তারা তাঁকে ধরতে পারল না।

তারপর মারওয়ান বললেন, এ তো সেই লোক যার সম্বন্ধে আল্লাহ্ অবতীর্ণ করেছেন, “আর এমন লোক আছে যে, মাতাপিতাকে বলে, তোমাদের জন্য আফসোস! তোমরা কি আমাকে এ ভয় দেখাতে চাও যে, আমি পুনরুত্থিত হব যদিও আমার পূর্বে বহু পুরুষ গত হয়েছে, তখন তার মাতাপিতা আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করে বলে, দুর্ভোগ তোমার জন্য। বিশ্বাস স্থাপন কর, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অবশ্যই সত্য। কিন্তু সে বলে এ তো অতীতকালের উপকথা ব্যতীত কিছুই নয়।” (একথা শুনে উম্মুল মুমিনীন “আয়েশা (রা:) পর্দার আড়াল থেকে বললেনঃ “আল্লাহ্ আমাদের ব্যাপারে কুরআনে কিছুই নাযিল করেন নি, কেবলমাত্র আমার নির্দোষিতা ছাড়া”)।

সুনানুন নাসাই আল কুবরা ও মুসতাদরাক লিল হাকিমের বর্ণনায়ঃ

মুহাম্মাদ বিন যায়দ বর্ণনা করেন যে যখন মু’আবিয়াহ তার ছেলের জন্য বায়আত নিচ্ছিলেন, মারওয়ান বললঃ “এটি আবু বাকার ও উমারের সুন্নাহ”। “আব্দুর রহমান জবাব দিলেনঃ “এটি হারকাল ও কায়সারের সুন্নাহ্”। তখন মারওয়ান বললঃ “এই সেই ব্যক্তি, যার ব্যাপারে কুরআনে অবতীর্ণ হয়েছে, আর এমন লোক আছে যে, মাতাপিতাকে বলে, তোমাদের জন্য আফসোস! তোমরা কি আমাকে এ ভয় দেখাতে চাও যে, আমি পুনরুত্থিত হব যদিও আমার পূর্বে বহু পুরুষ গত হয়েছে, তখন তার মাতাপিতা আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করে বলে, দুর্ভোগ তোমার জন্য। বিশ্বাস স্থাপন কর, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অবশ্যই সত্য। কিন্তু সে বলে এ তো অতীতকালের উপকথা ব্যতীত কিছুই নয়। [সুরা আহক্বাফ ৪৬:১৭] ।

একথা শুনে ‘আইশাহ্ বললেনঃ “আল্লাহর কসম! সে মিথ্যা বলেছে, আল্লাহ্ এই আয়াত আমাদের ব্যাপারে অবতীর্ণ করেননি। আর আমি যদি চাই, তাহলে বলতে পারি এই আয়াত কার সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। আমি আল্লাহর রসুল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে মারওয়ান ও তার পিতার ওপর লা’নত করতে শুনেছি, যখনও মারওয়ান জন্ম নেয়নি। কাজেই, মারওয়ান আল্লাহর লা’নতের ভাগীদার”।

[সহিহ বুখারী: ৪৮২৭, সুনানুন নাসাই আল কুবরাঃ ১১৪৯১, মুস্তাদরাক লিল হাকিমঃ ৮৪৮৩, ইমাম হাকিম বলেনঃ হাদিসটি বুখারী মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ]

অনেকে জালেমদের বাঁচাতে হাদীসের ভুল ব্যাখা করে – উমর (রা:) কে খলিফা নির্বাচন করেন আবুবকর (রা:)। প্রথমত – উমর (রা:) এর সাথে আবুবকরের (রা:) কোন রক্তের সম্পর্ক ছিলো না। দ্বিতীয়ত আবুবকর (রা:) প্রস্তাব দেন উমর (রা:)-কে খলিফা বানানোর জন্য, তা সাহাবীরা (রাঃ) মেনে নেন অর্থাৎ মজলিসে শুরার ঐক্যমত ছিল। তার খেলাফত নিয়ে কোন দ্বিমত ছিলো না।

তার খেলাফতকালে সবাই স্পষ্ট মত প্রকাশের (দ্বীনের ক্ষেত্রে) স্বাধীনতা ছিল। আর পরবর্তী রাজতন্ত্র ছিল কিসরা (ইরান) ও কায়সার (রোম) সমাট্রের সুন্নাহ, তারা তাদের আত্মীয়দের নির্বাচিত করতেন রাজা হিসেবে বা মৃত্যুর পর স্বজনরা রাজা হতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *