ওয়াসীলাহ পর্ব-১ (রসুল্লাহ (সা:) এর ওয়াসীলাহ)

ওয়াসীলাহ্ (وسيله) আরবি শব্দ। এর অর্থ উপায়, উপকরণ, নৈকট্য, মর্যাদা, অবস্থান, ব্যবস্থা, মাধ্যম যা দ্বারা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছা যায়। আরেকটি অর্থ হয় শাসকের নিকট সম্মান, মর্যাদা এবং নৈকট্য লাভ। ইসলামী পরিভাষায় এর অর্থ হলো আল্লাহর কাছে নৈকট্য বা সন্তুষ্টির জন্য এমন কোনো পন্থা, উপায় বা পথ অবলম্বন করা যা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং নৈকট্য লাভ করা যায়।

শরীয়ত অনুযায়ী কয়েকটি ওয়াসীলাহ বৈধ ধরা হয়।

১. আল্লাহর নাম দিয়ে তাকে ডাকাঃ

বান্দার জন্য সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ওয়সীলাহ হলো আল্লাহর নাম এবং তাঁর গুণাবলী দিয়ে ওয়াসীলা করা। অর্থাৎ আল্লাহর নাম দিয়ে তাঁর কাছে চাওয়া।

আল্লাহ্ বলেন,

“আর আল্লাহর জন্যই রয়েছে সুন্দরতম নামসমূহ। সুতরাং তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাক।”

সূরা আল আরাফ ৭:১৮০

অর্থাৎ আল্লাহর রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। সুতরাং হে বান্দারা তোমরা তাঁকে তাঁর সুন্দর নামের ওয়াসীলা দিয়েই ডাকো। অতএব, আল্লাহর সুন্দর নামের ওয়াসীলা দিয়েই আল্লাহ্কে ডাকতে হবে এবং ডাকা উচিত। আর এটাই আল্লাহ্কে ডাকার সঠিক পদ্ধতি। যা আল্লাহ্ নিজেই শিক্ষা দিচ্ছেন।

২. রসুল (সা:) এর ওয়াসীলা

৩. কোন বান্দার নেক কাজের উসিলা

৪. জীবিত নেককার ব্যক্তির ওয়াসীলায় (মাধ্যমে) দোয়া করা

তবে যে জিনিসটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি দ্বন্দ্ব সেটা হচ্ছে রসুলল্লাহ’(সা:) এর ওয়াসীলাহ। একদল এটার আলোচনা করেই না আর অনেকে এটাকে ভুল ব্যাখা করে শিরকে লিপ্ত।

আসুন সহীহ হাদীস অনুযায়ী রসুলল্লাহ’(সা:) এর ওয়াসীলাহ কি জানি-

জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আযান শুনে (আযানের শেষে) এই দুআ বলবে,
‘আল্লা-হুম্মা রাব্বা হা-যিহিদ দা‘অতিত্ তা-ম্মাহ, অস্স্বালা-তিল ক্বা-য়িমাহ, আ-তি মুহাম্মাদানিল অসীলাতা অলফাযীলাহ, অবআষহু মাক্বা-মাম মাহমূদানিল্লাযী অ‘আত্তাহ ।’
অর্থাৎ হে আল্লাহ এই পূর্ণাঙ্গ আহ্বান ও প্রতিষ্ঠা লাভকারী নামাযের প্রভু ! মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে তুমি অসীলা (জান্নাতের এক উচ্চ স্থান) ও মর্যাদা দান কর এবং তাঁকে সেই প্রশংসিত স্থানে পৌঁছাও, যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাঁকে দিয়েছ।
সে ব্যক্তির জন্য কিয়ামতের দিন আমার সুপারিশ অনিবার্য হয়ে যাবে ।” (বুখারী)

ফুটনোটঃ
(মুসলিম ৩৮৬, তিরমিযী ২১০, নাসায়ী ৬৭৯, আবূ দাঊদ ৫২৫, ইবনু মাজাহ ৭২১, আহমাদ ১৫৬৮)

রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ১০৪৬
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস

জাবির ইব্‌নু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

আল্লাহ্‌র রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আযান শুনে দু’আ করেঃ ‘হে আল্লাহ্‌-এ পরিপূর্ণ আহবান ও প্রতিষ্ঠিত সালাতের মালিক, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ওয়াসীলা ও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী করুন এবং তাঁকে সে মাকামে মাহমুদে পোঁছে দিন যার অঙ্গীকার আপনি করেছেন’–ক্বিয়ামাতের দিন সে আমার শাফা’আত লাভের অধিকারী হবে।

সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৬১৪
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস

হাদীস হতে বুঝা যায় এখানে ওয়াসীলাহ মানে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা। যখন কোন বান্দা আযানের পর ওয়াসীলাহ দোয়া ও দরুদ পড়ে দোয়া করে তারপর নিজের চাওয়া-পাওয়া আল্লাহর কাছে পেশ করে আল্লাহ কবুল করেন।

একটা কথা সুস্পষ্ট – কেউ দোয়া করুক না করুক রসুলল্লাহ’ (সা:) কে আল্লাহ শ্রেষ্ঠতম মর্যাদা দিবেন। কিন্তু বান্দা যখন আল্লাহর হাবীব, প্রিয় সৃষ্টির জন্য দোয়া করে (যা আল্লাহরই নির্দেশ) তখন আল্লাহ উক্ত বান্দার উপর সন্তুষ্ট হয় ফলে দোয়া করলে ইনশাআল্লাহ কবুল হয়।

হজরত ফাজালা ইবনে উবাইদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক লোককে নামাজে দোয়া করতে শুনলেন। কিন্ত সে তাতে আল্লাহর প্রশংসা করেননি এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর দরূদও পড়েননি। তা দেখে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘লোকটি তাড়াহুড়ো’ করলো।’ অতপর তিনি তাকে (ওই ব্যক্তিকে) ডাকলেন এবং তাকে বা অন্য কাউকে বললেন-‘যখন তোমাদের কেউ নামাজ পড়বে (নামাজে দোয়া করবে) তখন সে যেন প্রথমে তার মহান প্রভুর প্রশংসা ও গুণগান করে অতপর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর দরূদ পেশ করে। তারপর যা ইচ্ছা দোয়া করে।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)

হাদিসে এসেছে->> হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যতক্ষণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর দরূদ পড়া হবে না ততক্ষণ তা বাধাগ্রস্ত অবস্থায় থাকবে। অর্থাৎ এ দোয়া আল্লাহ তাআলার কাছে পৌঁছবে না এবং এ দোয়া কবুল করা হবে না।’ (তাবারানি)

কিন্তু এই ওয়াসীলাহকে ভুল ব্যাখা করে অনেকে জীবিত, মৃত বুজুর্গের কাছে চায়!! যা শিরক।

আল্লাহ বলেন –

“জেনে রাখুন, অবিমিশ্র আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য। আর যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যদেরকে অভিভাবকরূপে গ্ৰহণ করে তারা বলে, আমরা তো এদের ইবাদত এ জন্যে করি যে, এরা আমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দেবে। তারা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে নিশ্চয় আল্লাহ তাদের মধ্যে সে ব্যাপারে ফয়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী ও কাফির, নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হিদায়াত দেন না।”

সুরা যুমার- আয়াত ৩

মক্কার কাফের-মুশরিকরা, অনুরূপ দুনিয়ার সব মুশরিকও একথাই বলে থাকে যে, আমরা স্রষ্টা মনে করে অন্যসব সত্তার ইবাদাত করি না। আমরা তো আল্লাহকেই প্রকৃত স্রষ্টা বলে মানি এবং সত্যিকার উপাস্য তাকেই মনে করি। যেহেতু তাঁর দরবার অনেক উঁচু। আমরা সেখানে কি করে পৌঁছতে পারি? তাই এসব বুজুর্গ সত্তাদেরকে আমরা মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করি যাতে তারা আমাদের প্রার্থনা ও আবেদন-নিবেদন আল্লাহর কাছে পৌঁছিয়ে দেন। অথচ তারা জানত যে, এসব মূর্তি তাদেরই হাতের তৈরি। এদের কোন বুদ্ধি-জ্ঞান, চেতনা-চৈতন্য, ও শক্তি-বল কিছুই নেই। তারা আল্লাহ তা’আলার দরবারকে দুনিয়ার রাজা-বাদশাহদের দরবারের মতই ধারণা করে নিয়েছিল।

কিন্তু তাদের এসব ধারণা শয়তানী, বিভ্রান্তি ও ভিত্তিহীন কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রথমতঃ এসব মূর্তি-বিগ্রহ ফেরেশতাগণের আকৃতির অনুরূপ নয়। হলেও আল্লাহর নৈকট্যশীল ফেরেশতাগণ নিজেদের পূজা-অৰ্চনায় কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারে না। আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয় এমন যে কোন বিষয়কে তারা স্বভাবগতভাবে ঘৃণা করে। এতদ্ব্যতীত তারা আল্লাহর দরবারে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোন সুপারিশ করতে পারে না, যে পর্যন্ত না তাদেরকে আল্লাহ তা’আলা কোন বিশেষ ব্যক্তির ব্যাপারে সুপারিশ করার অনুমতি দেন।

কোন কোন সত্তা আল্লাহর কাছে পৌঁছার মাধ্যম সে ব্যাপারে দুনিয়ার মুশরিকরা কখনো একমত হতে পারেনি। কেউ একজন মহাপুরুষকে মানলে আরেকজন অপর একজনকে মানছে। কেননা, কেবল তাওহীদের ব্যাপারেই ঐক্যমত হওয়া সম্ভব। শির্কের ব্যাপারে কোন প্রকার ঐক্যমত হতে পারে না, ঐক্য হয় তাওহীদে।

আল্লাহ বলেন-

“আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ইবাদাত করছে যা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, এগুলো আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী। বলুন, তোমরা কি এমন কিছুর সংবাদ দেবে যা তিনি জানেন না? তিনি মহান, পবিত্র এবং তারা যাকে শরীক করে তা থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে।”

সুরা ইউনুস-১৮

অনেকে এগুলোর ভুল ব্যাখা করে যে কোন মানুষ কারো সাহায্য চাইলে কেন শিরক হবে!! আপনি বিপদে পড়লে সরাসরি কোন মানুষের কাছে সাহায্য বা ফোনে সাহায্য চাইতে পারেন, এটা দুনিয়ার জীবনের অংশ। কিন্তু শিরক তাকে বলা হয়েছে যা গায়েবী সাহায্য, যে কাছে নেই বা অদৃশ্য (মৃত ওলি, ফেরেশতা) তার নাম ধরে গায়েবী সাহায্য চাওয়া শিরক!! গায়েবি সাহায্য শুধু আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। যেমন – বৃষ্টিদাতা আল্লাহ, আর তিনি এই দায়িত্বে নিয়োজিত রেখেছেন ফেরেশতাকে। আজ পর্যন্ত কেউ কি ফেরেশতার কাছে বৃষ্টি চায়, তারা এটা মানে বৃষ্টি চাইতে হবে আল্লাহর কাছে। আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা দায়িত্ব পালন করবে। ঠিক তেমনি বান্দা আল্লাহর নিকট সাহায্য চাইবে, আল্লাহ কার মাধ্যমে বা কিভাবে সাহায্য করবে তা আল্লাহর ইখতিয়ার।

আল্লাহ বলেন –

“(হে ঐশীগ্রন্থধারিগণ!) কোন মানুষের পক্ষে এ হতে পারে না যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, প্রজ্ঞা ও নবুঅত দান করেন, তারপর সে লোকদেরকে বলে, ‘তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে আমার দাস হয়ে যাও।’ বরং সে বলে, ‘তোমরা রাব্বানী (আল্লাহ-ভক্ত) হও’;যেহেতু তোমরা কিতাব শিক্ষা দাও এবং যেহেতু তোমরা অধ্যয়ন কর। অনুরূপভাবে ফেরেশতাগণ ও নবীগণকে রবরূপে গ্রহণ করতে তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দেন না। তোমাদের মুসলিম হওয়ার পর তিনি কি তোমাদেরকে কুফরীর নির্দেশ দেবেন।”

সুরা আল ইমরান – ৭৯-৮০

আল্লাহ আরো বলেন-

“মরিয়ম-তনয় মসীহ রসূল ছাড়া আর কিছু নন। তাঁর পূর্বে অনেক রসূল অতিক্রান্ত হয়েছেন আর তার জননী একজন ওলী। তাঁরা উভয়েই খাদ্য ভক্ষণ করতেন। দেখুন, আমি তাদের জন্যে কিরূপ যুক্তি-প্রমাণ বর্ননা করি, আবার দেখুন, তারা উল্টা কোন দিকে যাচ্ছে। বলে দিনঃ তোমরা কি আল্লাহ ব্যতীত এমন বস্তুর এবাদত কর যে, তোমাদের অপকার বা উপকার করার ক্ষমতা রাখে না? অথচ আল্লাহ সব শুনেন ও জানেন!”

সুরা মায়েদাহ – ৭৫-৭৬

ঈসা (আ:) এর কাছে সাহায্য চাওয়া ও ইবাদত শিরক হলে মৃত বুজুর্গদের কাছে সাহায্য চাওয়া কি শিরক নয়!?

ইব্‌নু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি ‘উমর (রাঃ)-কে মিম্বারের ওপর দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছেন যে, আমি নবী‎ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, তোমরা আমার প্রশংসা করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করো না, যেমন ‘ঈসা ইবনে মারইয়াম (‘আঃ) সম্পর্কে নাছারা (খ্রিস্টানরা) বাড়াবাড়ি করেছিল। আমি তাঁর বান্দা, তাই তোমরা বলবে, আল্লাহ্‌র বান্দা ও তাঁর রাসূল।

সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৪৪৫
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *