উম্মাহর চরম বিপদে আমাদের করনীয় কি (আবেগ ও বাস্তবতা)?

সারা বিশ্বে (ফিলিস্তিনসহ) মুসলিমদের উপর চরম নির্যাতন, খুন, ধর্ষন, অনাহার, দুর্ভোগ চলছে। যা দেখে আমরা বড়ই মর্মাহত! প্রতিশোধের ইচ্ছে জ্বলে উঠছে। ছুটে যেতে চায় মন এসব মজলুমদের কাছে! তাদের হয়ে লড়তে, নাপাক শত্রুদের হতে পবিত্রভূমিকে রক্ষা করার দৃঢ় ইচ্ছে, শাহাদাতের সোনালী স্বপ্ন হাজারও যুবকের বুকে।

প্রত্যেক মুসলিমরা পরস্পর ভাই ভাই, একদেহের অঙ্গের মত কারো আঘাত পেলে মুমিনের কষ্ট লাগা ঈমানের বহিঃপ্রকাশ। এখানে ভূখণ্ড রেখা ও দেশীয় চেতনার কোন স্থান নেই। আরব, অনারবের মাঝে মুসলিমদের মর্যাদা ও ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য রাখা অনুচিত!!

কিন্তু বাস্তবতা অনুভব করতে হবে- কারো যদি সাধ্য ও সুযোগ থাকে পবিত্রভূমিকে রক্ষা করার ও ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার তা করা উচিত। আর পবিত্রভূমি মুক্ত মানে এই নয় যে – শুধু কাফেরদের হতে রক্ষা করা বরং মুনাফেক ও ইসলাম বিপরীত মতবাদ ও স্বৈরাচার হতে মুক্ত করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের (রা) জীবনী জানতে ও বুঝতে হবে।

কিন্তু আমরা চাইলে কি এসব ভূমিতে যেতে পারবো!? তথাকথিত মুসলিম দেশ কি বর্ডার ও ভিসা উন্মুক্ত করে দিবে আমাদের জন্য? তাহলে আমাদের করনীয় কি!!

এবার একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করি – বহুদূরে মুসলিম বোনের নির্যাতন, ধর্ষনের প্রতিরোধ করার ইচ্ছে থাকলেও সাধ্য আমাদের নেই। কিন্তু যখন আমাদের অতি পাশে প্রতিবেশী বোনটা ধর্ষিত হয়, এমনকি কোলের শিশু ধর্ষিত হচ্ছে , আমাদের সেই প্রতিবাদী ও জেহাদী চেতনা কোথায় হারিয়ে যায়!? আমরা সংখ্যায় অজস্র, ভূখন্ড, ভাষা নিজেদের তবুও ধর্ষিতদের প্রাপ্য বিচার দিতে পেরেছি কি!?

সিরিয়া, ইয়েমেনসহ বহুদেশে নিষ্পাপ শিশুদের ক্ষুধা, কষ্ট দেখে অনেক কিছু করতে চায় মন- অথচ সারাদেশে ফুটপাত জুড়ে ক্ষুধার্ত অসহায়, আশ্রয়হারা শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ছড়িয়ে আছে আমরা চাইলে অনেককিছু করতে পারি। আসলে আমরা কি কার্যকর কিছু করছি! প্রতিবেশীর হক কতটা আদায় করছি?

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জিবরীল (আ.) আমাকে প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে এত বেশি তাকিদ করেছেন যে, আমার কাছে মনে হয়েছে প্রতিবেশীকে মিরাছের অংশিদার বানিয়ে দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী ৬০১৪; সহীহ মুসলিম ২৫২৪)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৮৫)

বহুদূরের পবিত্রভূমির ওয়াজ করে অনেকে জেহাদের ফজিলত জানাচ্ছে, আবার আড়ালে অনেকে নিজেকে জনপ্রিয় করছে। অথচ দ্বীন ইসলাম ও মুমিনের মূল্য যেকোন ভূমির চেয়ে বেশি, তাহলে অতি নিকটবর্তী মায়ানমারের জন্য আমাদের জেহাদের ওয়াজ ও প্রস্তুতি কই ছিল বা কই গেল!? আর বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মুমিন রসুলের (সা:) চরিত্র নিয়ে যারা উপহাস, অবমাননা করে তাদের বিরুদ্ধে আমরা আসলে কার্যকর কিছু কি করতে পেরেছি!?

এখানে সংখ্যায়, জনবলে দুর্বল ও বহুদূর ভূখণ্ডের অজুহাত রোজ কেয়ামতে কাজে আসবে কি!?

প্রকৃত সমস্যা কি বুঝতে হবে!

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘শিগগির মানুষ তোমাদের আক্রমণ করার জন্য একে অপরকে আহ্বান করতে থাকবে, যেভাবে মানুষ তাদের সঙ্গে খাবার খাওয়ার জন্য একে অপরকে আহ্বান করে।’ জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসুল! তখন কি আমরা সংখ্যায় কম থাকবো।’ তিনি বললেন, ‘না, বরং তোমরা সংখ্যায় হবে অগণিত। কিন্তু তোমরা সমুদ্রের ফেনার মতো হবে, যাকে সহজেই সমুদ্রের স্রোত বয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা তোমাদের শত্রুর অন্তর থেকে তোমাদের ভয় দূর করে দেবেন এবং তোমাদের অন্তরে আল-ওয়াহান ঢুকিয়ে দেওয়া হবে।’ জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আল-ওয়াহান কি?’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল-ওয়াহান হলো- দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৭৫৩৯)

আমাদের ইসলাম ও মুসলিমের প্রতি আবেগ, ভালোবাসা আছে সত্যি কিন্তু দুনিয়ার ভালোবাসা ও মায়ার কাছে বার বার তা হার মেনে যায়। একদিকে আমাদের আলোচনা, প্রচারনা চলে বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত ভূমি, অসহায় রক্তাক্ত মুসলিম শিশুর। অন্যদিকে দুনিয়ার মায়ায় ক্রিকেট, ফুটবলের বিজয় উল্লাস আমাদের দুঃখ ও দায়িত্ব ভুলিয়ে দেয়।

যতটুকু আবেগ, চোখের জল তরুনদের নাটক, সিনেমা দেখে আসে ততটা ইসলাম ও মুসলিমের জন্য কি আসে!? আর মুমিনদের জন্য শয়তানের একটা বড় ফেতনা হল- আবেগতাড়িত করে বড় নেকীর কাজ হতে দূরে রেখে ছোট নেকীর কাজে ব্যস্ত রাখে। কারন সে চেষ্টা করেও মুমিনকে জেনাসহ পাপে ব্যস্ত রাখতে পারবে না বরং ভুল করলে মুমিন তওবা করে আরও বেশি নেক আমল করবে। তাই অন্যদেশের মুসলিমদের দুর্দশা দেখে আবেগী হয়ে কিছু নেক কাজ ঠিকই করছে কিন্তু আমাদের বিশাল দায়িত্ব নিজদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, জালেম ও রসুলের (সা:) অপবাদদাতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে ভুলিয়ে দিচ্ছে!!

শেষ জমানার হাদীসগুলো দেখুন- পূর্বদিক, খোরাসান হতে মনসুর ইয়ামেনী, হারস হাররাস বাহিনী জেরুজালেম বিজয় করবে। এরপর জেরুজালেম বিজয়ের পর একটা বাহিনী হিন্দুস্হানে পাঠাবে। তারা স্বৈরাচারী রাজাদের বন্দী করে নিয়ে আসবে এবং তাদের জীবিতরা ঈসার (আ:) সাথে দাজ্জালের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। (আবুূ দাউদ, আল ফিতান) (এগুলো নিয়ে বহু পোস্ট ওয়েবসাইটে পাবেন)।

এই সংগ্রাম ২-১ বছরের নয় বরং দীর্ঘ সংগ্রামী প্রক্রিয়া।
পূর্বদিকের বাহিনীতে বহুদেশের মুসলিম থাকবে। সবগুলো হাদীস ও পরিস্থিতি মেলালে দেখবেন তারা খোরাসানে ইসলাম, খেলাফাহ প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের শক্তিশালী করে অন্য মজলুমদেরও রক্ষা করতে যাবে। এবং দেখবেন- ওরা নিজ ভূখণ্ডে কাফের, মুনাফেকের মধ্যে আতংক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে বা হবে।

আর কাফের, মুনাফেকরা আমাদের ভয় পায় নাকি আমরা তাদের ভয়ে, সমালোচানায় সত্যি দাওয়াত ও প্রতিবাদ হতে দূরে থাকছি। আল্লাহ বলেন-

“হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে স্বীয় ধর্ম থেকে ফিরে যাবে, অচিরে আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালবাসবে। তারা মুসলমানদের প্রতি বিনয়-নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে জেহাদ করবে এবং কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ-তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্য দানকারী, মহাজ্ঞানী।”

সুরা মায়েদাহ -৫৪

আর শেষ জমানা খলিফা বা খেলাফতে ঈমাম মাহাদী হাফি সহ আহলে বায়াতের ভূমিকা থাকবে। অথচ বহুজন আহলে বায়াতের ফজিলত, খেলাফত বুঝেই না। আমরা আসলে কতটা দ্বীনের দাওয়াত পৌছাচ্ছি?

এই পথ বহুসংগ্রামের। রসুল (সা) ও সাহাবীরা মক্কার দাওয়াতী সংগ্রামী, রক্তঝরা জীবনের পর মদীনায় মুহাজির, আনসারদের সাথে নিয়ে লড়েছেন বদর, উহুূদ, খন্দকে। সেখানেও কষ্ট, ক্ষুধা, মুনাফেকদের সমালোচনা, ষড়যন্ত্র সবকিছুর বিরুদ্ধে লড়েছেন। আজও পথ দীর্ঘসংগ্রামের। দাওয়াত, জেহাদ বহুকিছু আমাদের করতে হবে, হতাশ হওয়ার সময় নেই।

মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেমন কাফের জোট খন্দকে একত্রিত হয়েছিল আজও হচ্ছে। ভবিষ্যতে রুম ও দাজ্জালের নেতৃত্বে হবে। আসলে মুমিনের সংগ্রাম সবসময় – ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথে কখনও বেলাল (রা), খুবায়েব (রা:), সমুাইয়ার (রা:) মত সবর আবার কখনও মুসায়েব বিন উমায়েরের (রা) মত আত্মত্যাগ, বিলীসী জীবন বিসর্জন, দাওয়াত, জেহাদ, শাহাদাত। কখনও হামযা (রা) সহ বহু সাহাবী এর মত হিজরত, জেহাদ ও শাহাদাৎ আবার আবু বকর (রা:), উমর (রা:), উসমান (রা,) আলীর (রা:) মত জান মাল দিয়ে জেহাদ ও নিজের সর্বোচ্চ ত্যাগ দেওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

আবার ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর আবু বকর (রা:), আলীর (রা:) মত মুরতাদ, মুনাফেকের সাথে জেহাদে অবতীর্ন হতে হবে। কুরআনের আয়াতের ভুল ব্যাখা করে যারা উম্মাহ ও খেলাফতকে ধ্বংস করতে চায়- তাদের ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রা) মত ফকীহ হয়ে যৌক্তিক মেকাবেলা করতে হবে। আবার কখনও সুন্নতকে জীবিত ও জালেম শাসকের বিরুদ্ধে সাহসী সত্যি সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে – হুসাইন (রা:) ও আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের (রা) মত।

তাই হতাশ না হয়ে পরিস্থিতি অনুযায়ী দ্বীনের কাজ চালিয়ে যান। ইনশাআল্লাহ ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবেই এটা আল্লাহর ওয়াদা। আর দেখার বিষয় – সেই পথে আমাদের অবদান অনুযায়ী জান্নাতের অবস্থান হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *