মা সবচেয়ে আবেগী বিষয়ের একটি। আজ সারাবিশ্বে মা দিবস পালিত হচ্ছে। অনেক মুসলিমও এই দিবস পালন করছে অথচ এই দিবস ও ইসলামে মায়ের মর্যাদা সম্পর্কে অধিকাংশেরই জ্ঞান নেই।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯০৭ সালের ১২ মে আমেরিকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্রাফটন শহরে প্রথমবার ‘মাদার্স ডে’ বা ‘মা দিবস’ পালিত হয়। দিবসটি পালনে এক ইতিহাসও রয়েছে। ভার্জিনিয়ায় অ্যান জার্ভিস নামে এক শান্তিবাদী সমাজকর্মী ছিলেন। নারী অধিকার নিয়ে তিনি কাজ করতেন।
তিনি ‘মাদার্স ডে ওয়ার্ক ক্লাব’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ছোট ছোট ওয়ার্ক ক্লাব গঠন করে সমাজে পিছিয়ে থাকা নারীদের এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেন তিনি। ধর্মপ্রাণ অ্যান নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য সহায়তা করতেন।
অ্যানের একটি মেয়ে সন্তান ছিল। যার নাম ছিল অ্যানা মারিয়া রিভস জার্ভিস। অ্যান একদিন ছোট মেয়ের সামনে হাত জোড় করে বলেছিলেন— আমি প্রার্থনা করি, কেউ না কেউ একদিন কোনও মায়ের জন্য একটা দিন উৎসর্গ করুক। কেননা, তারা প্রতিদিন নিজেদের জীবন মনুষ্যত্বের জন্য উৎসর্গ করে যাচ্ছেন। তাদের অধিকার এটা।
অ্যানার হৃদয়ে মায়ের সেই প্রার্থনা নাড়া দেয়। মায়ের মৃত্যুর দিনটি বিশ্বের প্রতিটি মায়ের জন্য উৎসর্গ করেন তিনি। এরপর থেকে মায়েদের প্রতি সম্মানে পালিত হয়ে আসছে মা দিবস।
১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের প্রতি দ্বিতীয় রোববারকে ‘মা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। তারপর থেকে দিনটি আন্তর্জাতিক মা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়। অথচ দিবসের মালিক একমাত্র আল্লাহ যিনি রাত-দিনের পরিবর্তন করেন। তিনিই নির্ধারণ করে দিয়েছেন কোনদিন কি দিবস (ঈদ, সাওম, হজ্জ) পালিত হবে।
হায়!! মুসলিমরাই আজ মা দিবস পালন করছে অমুসলিমদের নিয়মে। অথচ ইসলাম দিয়েছে মায়ের পূর্ণ মর্যাদা।
আল্লাহ কোরআনে বলেন,
“আমি মানুষকে তার মা-বাবার সঙ্গে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে; সুতরাং আমার শুকরিয়া ও তোমার মা-বাবার শুকরিয়া আদায় করো।”
সুরা লুকমান : ১৪
● একবার এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার কাছে কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার বেশি হকদার? তিনি বললেন, মা। লোকটি বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার বাবা। (বোখারি-মুসলিম)।
● ইসলাম মাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেন, ‘মা-বাবাই হলো তোমার জান্নাত এবং জাহান্নাম।’ (ইবনে মাজাহ-মিশকাত, পৃ. ৪২১)।
● অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, যখন কোনো অনুগত সন্তান নিজের মা-বাবার দিকে অনুগ্রহের নজরে দেখে, আল্লাহ তায়ালা তার প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে একটি করে কবুল হজের সাওয়াব দান করেন। (বায়হাকি-মিশকাত, পৃ.-৪২১)।
হায় মুসলিম!! তোমাকে আজ মায়ের মর্যাদা শিখতে হবে কাফেরদের হতে। দেখি সাহাবীরা মাকে কতটা ভালোবাসতেন!!
হযরত আবু হুরায়রার (রা) মা
একদিন হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) নবীজি (সা.) এর নিকট এসে কাঁদছেন। নবীজি জিজ্ঞেস করলেন, হে আবু হুরায়রা তুমি কেন কাঁদছ? জবাবে আবু হুরায়রা বললেন, আমার মা আমাকে মেরেছেন। রাসুল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কেন তুমি কি কোন বেয়াদবি করেছ?
আবু হুরায়রা বললেন, না হুজুর কোন বেয়াদবি করিনি। আপনার দরবার হতে বাড়ি যেতে আমার রাত হয়েছিল বিধায় আমার মা আমাকে দেরির কারণ জিজ্ঞেস করায় আমি আপনার কথা বললাম। আর আপনার কথা শুনে মা রাগে আমাকে মারধর করল আর বলল, “হয়ত আমার বাড়ি ছাড়বি আর না হয় মোহাম্মদ সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবার ছাড়বি।”
আমি বললাম, “ও আমার মা। তুমি বয়স্ক মানুষ। তোমার গায়ে যত শক্তি আছে তত শক্তি দিয়ে মারতে থাকো। মারতে মারতে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দাও। তবুও আমি আমার রাসুলকে ছাড়তে পারবো না।”
তখন রাসূল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমার মা তোমাকে বের করে দিয়েছেন আর এজন্য আমার কাছে নালিশ করতে এসেছ? আমার তো এখানে কিছুই করার নেই।”
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বললেন, “হে রাসূল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমি আমার মায়ের জন্য এখানে নালিশ করতে আসিনি।”
রাসুল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাহলে কেন এসেছ?”
আবু হোরায়রা বললেন, আমি জানি আপনি আল্লাহর নবী। আপনি যদি হাত উঠিয়ে আমার মায়ের জন্য দোয়া করতেন, যাতে আমার মাকে যেন আল্লাহ হেদায়েত করেন।
আর তখনই সাথে সাথে রাসুল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত উঠিয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন, “হে আল্লাহ! আমি দোয়া করি আপনি আবু হোরায়রার আম্মাকে হেদায়েত করে দেন।”
রাসুল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করলেন আর আবু হোরায়রা বাড়ির দিকে দৌড়ে যাচ্ছেন। পিছন থেকে কয়েকজন লোক আবু হোরায়রার জামা টেনে ধরল এবং বললো, হে আবু হোরায়রা! “তুমি দৌড়াচ্ছ কেন?”
তখন আবু হোরায়রা বললেন, “ওহে সাহাবীগণ তোমরা আমার জামা ছেড়ে দাও। আমাকে দৌড়াতে দাও।”
“আমি দৌড়াইতেছি এই কারণে যে, আমি আগে পৌঁছলাম নাকি আমার নবীজির দোয়া আগে পৌঁছে গেছে।”
হযরত আবু হুরায়রা দরজায় ধাক্কাতে লাগলো। ভেতর থেকে তার মা যখন দরজা খুললো তখন আবু হুরায়রা দেখলেন তার মার সাদা চুল বেয়ে বেয়ে পানি পড়ছে। তখন মা আমাকে বললেন, “হে আবু হুরায়রা! তোমাকে মারার পর আমি বড় অনুতপ্ত হয়েছি, অনুশোচনা করেছি। মনে মনে ভাবলাম আমার ছেলে তো কোন খারাপ জায়গায় যায়নি। কেন তাকে মারলাম? আমি বরং লজ্জায় পড়েছি তোমাকে মেরে। হে আবু হুরায়রা! আমি গোসল করেছি। আমাকে তাড়াতাড়ি রাসুল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে নিয়ে চল।”
আর তখনই সাথে সাথে আবু হুরায়রা তার মাকে রাসুল (সাঃ) এর দরবারে নিয়ে গেলেন। আর তার মা সেখানেই কালিমা পাঠ করে মুসলমান হয়ে গেলেন।
● হাদিসে বর্ণিত, “পিতা মাতা জান্নাতের মাঝের দরজা। যদি চাও, দরজাটি নষ্ট করে ফেলতে পারো, নতুবা তা রক্ষা করতে পারো।” সুবাহান আল্লাহ! [তিরমিজি ]।
সাহাবীরা মাকে এতটা ভালোবাসতো যে তাকে জান্নাতে দেখতে চাইতেন। তাই তার হেদায়েতের জন্য দোয়া ও দাওয়াত দিতেন। আপনারা মাকে ভালোবাসেন অথচ মাকে সঠিক আকীদার দাওয়াত দিচ্ছেন না!! চিন্তা করুন দুনিয়াতে যে মায়ের কষ্ট সহ্য করতে পারেন না, জাহান্নামে মা কিরূপ কষ্ট করবে!!
হজরত সা’দের (রাঃ) মা
ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে তাঁর মা পুত্রের মুসলিম হওয়ার খবর শুনে চিৎকার শুরু করে দেন। তাঁর চেঁচামেচিতে লোকজন জড়ো হয়ে যায়। সাদ (রাঃ) মায়ের কাণ্ড দেখে ঘরের এক কোণে নীরব অবস্থান গ্রহণ করেন।
তাঁর মা কিছুক্ষণ শোরগোল করার পর ছেলেকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য চরমপত্র ঘোষণা করলেন।
তিনি বললেন, ‘সে যতক্ষণ না মুহাম্মদের (সাঃ) ধর্ম থেকে ফিরে আসবে, ততক্ষণ আমি কোনো কিছু খাব না, পান করব না এবং রোদ থেকে ছায়াতেও আসব না।’
মায়ের ঘোষণা শুনে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিন দিন কেটে গেল, সা’দের (রাঃ) মা খাবার বা পানীয় কোনো কিছু স্পর্শ করলেন না, কারো সঙ্গে কথাও বললেন না, রোদ থেকে ছায়াতেও এলেন না।
সাদ (রাঃ) অস্থির হয়ে পড়লেন। তিনি রাসুল (সা.)-এর দরবারে হাজির হলেন। ঘটনা বিস্তারিত রাসুল (সা.)কে অবহিত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে পবিত্র কোরআনের আয়াত নাজিল হলো,
“আমি মানুষকে মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি। যদি তারা তোমাকে আমার সঙ্গে এমন কিছুকে শরিক করার জন্য পীড়াপীড়ি করে, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি সে বিষয়ে তাদের আনুগত্য কোরো না। আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। এরপর আমি তোমাদের জানিয়ে দেব তোমাদের কর্মফল।’
সুরা আল-আনকাবুত, আয়াত ৮
পবিত্র কোরআনের এ আয়াতটি নাজিল হওয়ার পর হজরত সাদ (রা.)-এর মনের অশান্তি দূর হলো। শেষাবধি দৃঢ়তার সাথে বললেন, যদি তোমার দেহে একশ জীবনও সঞ্চারিত হয়। আর তা এক এক করে মৃত্যু বরণ করে তবুও আমি আমার ঈমান ত্যাগ করব না।
ছেলের এই দৃঢ়তায় তাঁর মা নিরাশ হয়ে অনাহার ভঙ্গ করতে বাধ্য হয়। সাদ (রা) এর দৃঢ়তায় একদিন তার মায়ের হৃদয়ে ভাবান্তর ঘটে। তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন।
দেখুন – কুরআনে সুস্পষ্ট বলছে মা-বাবার ভালোবাসা যেন ইসলাম পালনে বাধা না হয়।
আজ আমাদের অবস্থা দেখুন-
বহুক্ষেত্রে মায়ের কথা না শুনা ছেলেটাও মায়ের আপত্তির কারণে দাঁড়ি কেটে ফেলে। মায়ের প্রতি ভালোবাসা মানে এই নয় বিভিন্ন দিবস পালন (মা দিবস, জন্ম, বিবাহবার্ষিকী)। বরং মাকে আহ্বান করুন জান্নাতের পথে। যেখানে কাউকে বাধ্যক্য স্পর্শ করবে না, না দুনিয়ার মত বিচ্ছেদের ভয় থাকবে। যখনি চাইবে পরস্পরের সাক্ষাৎ হবে।