আশুরার মহত্ত্ব ও উম্মাহর অনুধাবন

আশুরা বা ১০ই মহররম মুসলিম উম্মাহর জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ দিন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই আশুরার মূল প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অবহিত নয়।

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সা.) যখন হিজরত করে মদিনা পৌঁছেন, তখন তিনি দেখলেন যে মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিনে রোজা পালন করছে।

তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, আশুরার দিনে তোমরা রোজা রেখেছ কেন? তারা উত্তর দিল, এই দিনটি অনেক বড়। এই পবিত্র দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফিরআউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন আর ফিরআউন ও তার বাহিনী কিবতি সম্প্রদায়কে ডুবিয়ে মেরেছিলেন।
এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হজরত মুসা (আ.) সিয়াম রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার সিয়াম পালন করে থাকি।
তাদের উত্তর শুনে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, হজরত মুসা (আ.)-এর কৃতজ্ঞতার অনুসরণে আমরা তাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতঃপর তিনি নিজে আশুরার সিয়াম রাখেন এবং উম্মতকে তা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন। (বুখারি-৩৩৯৭, মুসলিম-১১৩৯)।

আশুরার রোজার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। এ বিষয়ে কয়েকটি হাদিস শুনি- ‘হজরত আবু কাতাদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.)-কে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এই রোজা বিগত বছরের গুনাহ মুছে দেয়। (মুসলিম-১১৬২)। ‘রাসুল (সা.) বলেন- ‘রমজান মাসের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা আল্লাহর মাস মহররমের আশুরার রোজা।’ (সুনানে কুবরা-৪২১০)

আশুরার রোজা ও ইহুদি সম্প্রদায়: মুসলিম শরিফে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত- ‘মহানবী (সা.) যখন আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ প্রদান করেন, তখন সাহাবিরা অবাক হয়ে বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! ইহুদি-নাসারারা তো এই দিনটিকে বড়দিন মনে করে। (আমরা যদি এই দিনে রোজা রাখি, তাহলে তো তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য হবে। তাদের প্রশ্নের উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, ‘তারা যেহেতু এদিন একটি রোজা পালন করে) আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা এই ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা পালন করব। (মুসলিম-১১৩৪)।

তার মানে হাদীস অনুযায়ী – ফেরাউন ও তার বাহিনীর পতনের খুশিতে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মুসা (আঃ) সিয়াম পালন ও পরবর্তীতে রসুলুল্লাহ (সাঃ) তা পালনের নির্দেশ দেন। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ মানুষই ফেরাউনের চরিত্র ও তার ধ্বংসের কারণ সম্পর্কে জানে না।

আসুন ফেরাউনদের নীতিরীতি বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জেনে নিইঃ

১. জাতিকে বিভক্ত করা – আল্লাহ বলেন, “ফেরাউন তার দেশে উদ্ধত হয়েছিল এবং সে দেশবাসীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে তাদের একটি দলকে দূর্বল করে দিয়েছিল। সে তাদের পুত্র-সন্তানদেরকে হত্যা করত এবং নারীদেরকে জীবিত রাখত। নিশ্চয় সে ছিল অনর্থ সৃষ্টিকারী।” [সুরা কাসাস – ২৮:৪)। মূলত ফেরাউন ছিল কিবতী জাতি আর ইউসুফ (আঃ) ছিল বনী ইসরায়েল। ওহীর জ্ঞানের ভিত্তিতে ইউসুফ (আঃ) শাসন করতেন পরবর্তীতে বনী ইসরায়েলের কাছে তাওরাতের জ্ঞান থাকায় ওরা ছিল সম্মানিত।

কিন্তু বনী ইসরায়েল কিতাবের জ্ঞান হতে দূরে সরে যায়, আর ফেরাউনরা তাদের দলে দলে বিভক্ত করে দূর্বল করে রাখে।

কারণ তারা ভয় পেত বনী ইসরায়েলের কাছে ওহীর জ্ঞান ছিল, তারা এই ভিত্তিতে শাসন করতো, তাই ফেরাউনদের ক্ষমতার জন্য তারা সবচেয়ে বড় বাধা হবে। একসময় মুসলিমরা অর্ধবিশ্ব শাসন করতো, পবিত্র কিতাব দ্বারা। মুসলিমরা ছিল ঐক্যবদ্ধ জাতি। এই যুগের ফেরাউনরা আমাদের দলে দলে বিভক্ত করে দুর্বল করে রেখেছে আর আমরাও বনী ইসরায়েলের মত কিতাবের অনুসরণ হতে দূরে সরে এসেছি তাই পতিত হয়েছি।

২. রিজিক নিয়ে মিথ্যাচার – ফেরাউনকে যখন দাওয়াত দেওয়া হল- তখন ঈমান আনার পরিবর্তে উল্টো যুক্তি দিল-

ফির‘আউন বলল, ‘আমরা কি তোমাকে শৈশবে আমাদের মাঝে লালন পালন করিনি? আর তুমি তোমার জীবনের অনেক বছর আমাদের মধ্যে অবস্থান করেছ’। (সুরা শুআর-১৮)। অথচ ফেরাউন আল্লাহর জমিনে আল্লাহর সম্পদ ভোগ করে বনী ইসরায়েল জাতিকে দাসে পরিণত করেছিল।

তাই মুসা (আঃ) বলেছিল- আর আমার প্রতি তোমার যে অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে তুমি দয়া দেখাচ্ছ তা তো এই যে, তুমি বনী ইসরাঈলকে দাসে পরিণত করেছ। (সুরা শুআরা- ২২)।

আজ দেখুন- ফেরাউনদের যখন দাওয়াত দেওয়া হয়- তখন ওরা বলে এদেশের সম্পদ ভোগ করে বড় হয়ে এদেশের আইন, চেতনা, ঐতিহ্যের বিরোধিতা করে। অথচ ওরা আল্লাহর জমিনের সম্পদ ভোগ করেছে আর জাতিকে করের দাসে পরিণত করছে।

তাদের ক্ষমতাসীনরা কর ফাকি দিয়ে চলছে। আর বিশ্ব ফেরাউনরা মুসলিমদের সম্পদ লুন্ঠন করে ওদের দরিদ্র্য করে রাখছে, কেউ যদি প্রতিবাদী হয় তখন বলে – তোমাদের দেশে এত এত টাকা অনুদান দিতাম, সব বন্ধ করে দিবো।

৩. দেশদ্রোহীতার অভিযোগ – মুসা (আঃ) ও হারুন (আঃ) যখন ফেরাউনদের শিরকী নিয়মনীতি বাদ দিয়ে এক আল্লাহর দিকে আহ্বান করছিল তখন তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ তুলে। এমনকি জাদুকররা ঈমান আনলেও একই অভিযোগ তুলে।

কুরআনে বর্নিত – “সে বললঃ হে মূসা, তুমি কি যাদুর জোরে আমাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কার করার জন্যে আগমন করেছ?” (সুরা ত্বাহা-৫৭)।

সুরা আরাফে আছে – “ফেরাউন বলল, তোমরা কি (তাহলে) আমার অনুমতি দেয়ার আগেই ঈমান আনলে! এটা প্রতারণা, যা তোমরা এ নগরীতে প্রদর্শন করলে। যাতে করে এ শহরের অধিবাসীদিগকে শহর থেকে বের করে দিতে পার। সুতরাং তোমরা শীঘ্রই বুঝতে পারবে।” (আয়াত- ১২৩)। আজও ফেরাউনদের রাষ্ট্রীয় শিরকী নিয়মনীতির বিরোধিতা করলে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ও মামলা দেয়।

৪. আল্লাহকে রব মানার কারণে হত্যার চেষ্টা – ফেরাউনদের এক আল্লাহর আনুগত্য ও নিয়মনীতিরই দিকে ডাকা হতো তারা তা প্রত্যাখান করে উল্টো হত্যার পরিকল্পনা করতো। সুরা মুমিনে রয়েছে,

“অতঃপর মূসা যখন আমার কাছ থেকে সত্যসহ তাদের কাছে পৌঁছাল; তখন তারা বলল, যারা তার সঙ্গী হয়ে বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাদের পুত্র সন্তানদেরকে হত্যা কর, আর তাদের নারীদেরকে জীবিত রাখ। কাফেরদের চক্রান্ত ব্যর্থই হয়েছে। ফেরাউন বলল; তোমরা আমাকে ছাড়, মূসাকে হত্যা করতে দাও, ডাকুক সে তার পালনকর্তাকে! আমি আশংকা করি যে, সে তোমাদের ধর্ম পরিবর্তন করে দেবে অথবা সে দেশময় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। মূসা বলল, যারা হিসাব দিবসে বিশ্বাস করে না এমন প্রত্যেক অহংকারী থেকে আমি আমার ও তোমাদের পালনকর্তার আশ্রয় নিয়ে নিয়েছি। ফেরাউন গোত্রের এক মুমিন ব্যক্তি, যে তার ঈমান গোপন রাখত, সে বলল, তোমরা কি একজনকে এজন্যে হত্যা করবে যে, সে বলে, আমার পালনকর্তা আল্লাহ, অথচ সে তোমাদের পালনকর্তার নিকট থেকে স্পষ্ট প্রমাণসহ তোমাদের নিকট আগমন করেছে? যদি সে মিথ্যাবাদী হয়, তবে তার মিথ্যাবাদিতা তার উপরই চাপবে, আর যদি সে সত্যবাদী হয়, তবে সে যে শাস্তির কথা বলছে, তার কিছু না কিছু তোমাদের উপর পড়বেই। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালংঘনকারী, মিথ্যাবাদীকে পথ প্রদর্শন করেন না।” (২৫-২৮)।

আজও কেউ একমাত্র রব আল্লাহর শরীয়া চাইলে জালেমরা একই ষড়যন্ত্র করে।

৫. ছেলে শিশুদের হত্যা কর- ফেরাউনরা ছেলেশিশুদের হত্যা করতো যেন কেউ মুসলিম হয়ে তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করার কারণ না হয় আর নারীদের জীবিত রেখে ওদের নিজের ভোগে পরিণত করত যেন ওদের গর্ভে জালেমদের সন্তানগুলো ফেরাউনদের দ্বীনে (জীবন-বিধান) দীক্ষিত হয়। এভাবে মুসলিমদের নিধন আর ওদের অনুসারী বাড়াতে চাইতো। আজও অনেক মুসলিম দেশগুলোতে শিশুদের এমনভাবে হত্যা করা হয় ভবিষ্যতে যেন মুজাহিদ তৈরি হতে না পারে। চীনসহ বহুদেশে নারীদের বন্দী করে কাফেরের সন্তান জন্ম দিতে বাধ্য করা হয়।

৬. কুফরী শিক্ষা দিয়ে দ্বীনী শিক্ষাকে প্রতিরোধের চেষ্টা – মুসা (আঃ) এর দাওয়াতকে ভুল প্রমাণ করতে ফেরাউন জাদুকরদের কুফরী জাদু শিক্ষাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল উল্টো জাদুকররা দ্বীনে ফিরে আসে।

বর্তমানে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদ, তন্ত্রমন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসারের চেষ্টা চলছে অথচ এসব শিক্ষায় দীক্ষিতরা হেদায়েত পেয়ে ইসলামের সত্যতা ছড়াচ্ছে।

৭. পূর্বপুরুষের আত্মীয়তা নিয়ে বড়াই – ফেরাউনরা মমি তৈরি করতো। আর প্রচার করতো অমুক পূর্বপুরুষের বংশধর তাই তারাও ক্ষমতার হক্বদার।

ফেরাউন শব্দের অর্থ হল রা দেবতার পুত্র। ঐতিহাসিকদের মতে- তখন মিশরের সূর্য দেবতা মানতো আমন রা কে। আর ফেরাউন নিজেদের এই দেবতার সাথে সম্পর্কিত করে ক্ষমতার দাবি করতো। আজ দেখুন- কারো পূর্বপুরুষের মূর্তি, কবরকে মাজারে পরিণত করে তাদের কীর্তি শুনিয়ে ক্ষমতার দাবি করছে।

৮. বিপদে মুসলিমদের কাছে দোয়া প্রার্থনা – ফেরাউনদের কাছে কোন আসমানী বালা মুসিবত এলে মুসা (আঃ) এর কাছে গিয়ে দোয়া করতে বলত। আল্লাহ বলেন- “আর তাদের উপর যখন কোন আযাব পড়ে তখন বলে, হে মূসা আমাদের জন্য তোমার পরওয়ারদেগারের নিকট সে বিষয়ে দোয়া কর যা তিনি তোমার সাথে ওয়াদা করে রেখেছেন। যদি তুমি আমাদের উপর থেকে এ আযাব সরিয়ে দাও, তবে অবশ্যই আমরা ঈমান আনব তোমার উপর এবং তোমার সাথে বনী-ইসরাঈলদের যেতে দেব।” [৭:১৩৪]।

মাত্র কয়েক মাস আগে যখন করোনায় বিশ্ব ফেরাউনরা ভয়ে কাপছিল তখন বহুদেশে প্রকাশ্যে আযান, সালাত পড়তে দিল আর বহুদেশের সংসদ হতে মুসলিমদের দোয়া করতে বলল। যখন কোভিড কমে এল মুসলিম নির্যাতন বেড়ে গেল যেমনটা ফেরাউনদের অনুসারীরা করতো।

৯. সমূলে হত্যার চেষ্টা – ফেরাউন যখন বনী ইসরায়েলকে দ্বীন হতে ফিরাতে ব্যর্থ হলো তখন তাদের সমূলে হত্যা করতে চেয়েছিল। কারণ বনী ইসরায়েল যদি তার প্রভুত্ব বাদ দিয়ে চলে যেতে সমর্থ হয়, ধীরে ধীরে সবাই হয়তো তার প্রভুত্বকে অস্বীকার করবে। আজও কেউ শক্তিশালী রাষ্ট্রের বিরোধিতা করলে তাদের জনগণকে সমূলে হত্যার চেষ্টা করা হয় যাতে অন্যরা তাদের প্রভুত্ব অস্বীকার করার সাহস না পায়।

অপরদিকে আশুরায় হোসেনের (রাঃ) শাহাদাতকে কেন্দ্র করে বাড়াবাড়ি ও শিরকে লিপ্ত হচ্ছে অনেকে। রাসুলের (সাঃ) জীবদ্দশায় দ্বীন পূর্নাঙ্গ হয়ে গেছে – আর হোসেন (রাঃ) এর শাহাদাত এর পরে ঘটে।

এটা সত্যি হোসেন (রাঃ) এর প্রতি ভালোবাসা ঈমানের পরিচয়, তিনি শহীদ যুবকদের সর্দার ও আমাদের অনুকরণীয় চরিত্র।

যখন মুসলিমদের আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামসম্মত মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল, জুলুম চলছিল। তখনই হোসেন (রাঃ) প্রতিবাদী হোন, শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বন্ধ হলে তিনি সংগ্রাম করে শহীদ হোন।

অথচ বর্তমানে ফেরাউনদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক প্রকাশ করা হয় আর হোসেন (রাঃ) এর আর্দশের অনুরূপ সংগ্রামরত হয়ে শাহাদাত বরণ করলে কথিত মুসলিমরাই খুশি হয়!!

আসলে কি আমরা আশুরার মর্ম বুঝেছি?!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *