আমাদের সফলতা আসলে কোথায়!! দুনিয়াই কি সন্তানের সফলতা?

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়, তেজগাঁও রেলস্টেশনের পাশে বসেছিলাম। বিষন্ন হৃদয় শান্তিময় হিমেল হাওয়ায় নিজের জীবনের হিসাব কষছিলাম। পেটটা খালি তবুও বাসায় ফিরতে মন চাইছে না।

বাসার একসময়ের প্রিয় মানুষদের কাছে যেন আমি অনেক বড় অপরাধী। হারাম হওয়ায় পর পর কয়েকটা ব্যবসা ও জব ছেড়েছি। তাই নিয়ে নিত্য সমালোচনা চলে বংশের কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ অনেক ধনী আর আমার নাকি ভবিষ্যত অন্ধকার!! অথচ সবারই আয় হালাল নয় কেউ তাগুতের গোলামী করে, কেউ লোভে হারাম আয় করে চলছে। তবুও ঘরে ওদের সফলতার প্রশংসা ও উদাহরণ চলে। মধ্যবিত্ত পরিবার এমন না খুব অভাবী তবুও স্বজনদের মুখে ভবিষ্যৎ অভাবের আতংক বিরাজ করে। আমার তেমন আয় না থাকলেও বাকীদের মোটামুটি আয় ছিল।

অথচ আমাদের ফ্রীজগুলো খালি ছিল না আর রসুল (সাঃ) ও সাহাবীদের পেটটাই খালি থাকতো তবুও আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে চলতেন। তারা এই আয়াতগুলোর প্রতি আমল করতেন,

“আর তুমি ভরসা কর এমন চিরঞ্জীব সত্তার ওপর যিনি মরবেন না।”

সূরা আল ফুরকান, আয়াত: ৫৮

‘‘আর আল্লাহর ওপরই মুমিনদের ভরসা করা উচিত।’’

সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ১১

“অতঃপর তুমি যখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তখন আল্লাহর ওপর ভরসা কর।”

সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯

‘‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্যে যথেষ্ট।’’

সূরা আত-তালাক, আয়াত: ৩

তাই তারা ছিল সফল।

সমাজটাও বড় অদ্ভুত হয়ে গেছে!! পিতামাতা যেন ঐ সন্তানকে সফল ভাবে যার আয়টা বেশি। হোক সেটা হালাল বা হারাম। আয় করে তাদের খরচ ও অর্থকড়ি জমাতে পারলে তাকে নিয়ে গর্ব করে।

এসব যখন ভাবছিলাম তখন দেখলাম টোকাইয়ের মত ১৪-১৫ বছরের তিনটা ছেলে পাশে এসে বসছে। হাতের পলিথিনে কিছু ভাত আর ওদের মধ্যে বড় ছেলেটা ১০ টাকা দিয়ে অন্য ছেলেটাকে বলল- ডাল নিয়ে আস একসাথে খাবো। চোখে জল চলে এলো- আহ!! মাত্র সামান্য খাবার তাও তারা মিলেমিশে ভাগ করে খায় অথচ তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই।

আর আমাদের পরিবারগুলো যারা উচ্চশিক্ষায় দীক্ষিত তারা পরস্পর জমি ও অর্থ নিয়ে কলহ করে, একজনের আয় একটু কম হলে ওদের ঘাড়ে যেন বিশাল বোঝা মনে হয়।

মাঝেমধ্যে টোকাই শিশুদের খাওয়া দিতাম দেখতাম তারা কি সুন্দর মিলেমিশে ভাগ করে খায়!! আসলে ওদের অভাবটা হল জীবনে আর আমাদের অভাব হলো মনে। জীবনের অভাব একসময় শেষ হয় কিন্তু মনের অভাব আল্লাহর রহমত ছাড়া শেষ হয় না।

আল্লাহ বলেন,

“তুমি বল, নিশ্চয় আমার রব যার জন্য চান রিজিক সম্প্রসারিত করে দেন এবং সংকুচিতও করে দেন কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।”

সুরা সাবা : আয়াত ৩৬

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হে আদম সন্তান, আমার ইবাদতের জন্য তুমি ঝামেলামুক্ত হও, আমি তোমার অন্তরকে প্রাচুর্য দিয়ে ভরে দেব এবং তোমার দারিদ্র্য ঘুচিয়ে দেব। আর যদি তা না কর, তবে তোমার হাত ব্যস্ততায় ভরে দেব এবং তোমার অভাব দূর করব না।’ (তিরমিজি, মুসনাদে আহমদ ও ইবনে মাজাহ)

আল্লাহর রহমত হল এই -তিনি মুমিনের অন্তরে প্রাচুর্য ঢেলে দেন ফলে সে অল্পতে তৃপ্ত হয়, দুনিয়ার লোভ লালসা তাকে আকৃষ্ট করে না।

আল্লাহ বলেন-

“যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আযাব বড় কঠিন।'”

সুরা ইবরাহিম: আয়াত ৭

মুমিনের জীবনে অভাব, কষ্ট হলো আল্লাহর বিশেষ রহমত যা তাকে ইসলামের পথে নিয়ে আসে।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়মিত ইসতেগফার করবে আল্লাহ তাআলা তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের সংস্থান করে দেবেন।’ (আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)।

মনে পড়ে আয়হীন সেদিনগুলোতে তওবা, ইস্তেগফার ও ইসলামের জ্ঞান অর্জন করেছি যে পরবর্তী জীবনে যার সুফল পেয়েছিলাম। চারপাশে বেশিরভাগ মানুষের মনোভাব এমন – অর্থনৈতিকভাবে সফল না হলে তার মূল্যবান দ্বীনী কথাও মানুষ গ্রহণ করতে চায় না।

একটু খেয়াল করে দেখবেন – যে আলেম মুখরোচক, জনগনের মন জয়ের জন্য কথা বলে তার জনপ্রিয়তা ও অর্থ আয়ের পরিমান বেশি হয়। আর যারা হক্ব কথা বলে বেড়ায় তার মেনে নিতে হয় দারিদ্র্যতা, জুলুম, কারাবাস।

বর্তমান যুগে মুসলিমদের কাছে সফলতার সংজ্ঞাই বদলে গেছে – যে যত বেশি ধনী, খ্যতিবান, সার্টিফিকেটকধারী, উচ্চ চাকরিজীবী সে তত বেশি সফল।

তাই তো একই পরিবারের একভাই যদি চাষাবাদ বা সিএনজি চালিয়ে হালাল আয় করে আরেকজন সুদের ব্যাংকে চাকরি বা ব্যবসা করে, দেখবেন -অভিভাবকরাও সুদের টাকায় ধনী হওয়া ছেলেটাকে নিয়ে গর্ব করবে আর গরিব চাষী/রাখাল/সিএনজি চালাকের পরিচয় দিতে লজ্জা পাবে। অথচ নবীগণ বকরি চরিয়েছেন ও দারিদ্র্য জীবনযাপন করেছেন। তাহলে শুধু পেশাগত কারণে কাউকে ছোট ভাবলে নবী, রসুলগনদের পেশাকে ছোট ভাবা হয়।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে হাদিসে বর্ণিত আছে, ‘রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, এমন কোনো নবী নেই যিনি ছাগল চরাতেন না। সাহাবিরা আরজ করলেন, আপনিও? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমিও কয়েক কিরাতের বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল চরিয়েছি।’ (বুখারী)

অপরিদকে ফেরাউন, নমরুদ, কারুনদের মত অভিশপ্তরা ছিল বিশাল অবৈধ সম্পদের মালিক।

“নিশ্চয়ই ‘কারুন’ মূসার সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল, কিন্তু সে তাদের প্রতি জুলুম করেছিল। আমি তাকে এতটা ধন-ভাণ্ডার দান করেছিলাম, যার চাবিগুলো বহন করা একদল বলবান লোকের পক্ষেও কষ্টসাধ্য ছিল। (স্মরণ করুন তখনকার কথা) যখন তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল- দম্ভ করো না, আল্লাহ দাম্ভিকদের ভালোবাসেন না।”

সূরা আল-কাসাস; আয়াতঃ ৭৬

সফলতার প্রকৃত পরিচয় মিলবে – আখিরাতে, দুনিয়াতে নয়।

কোরআনে কারিমে অন্যত্র আরও বলা হয়েছে,

“তোমরা দুনিয়াকে পরকালের ওপর প্রাধান্য দিয়ে থাকো, অথচ দুনিয়ার তুলনায় পরকাল উত্তম; কারণ সেখানেই আসল সফলতা।”

সূরা আলা: ১৬-১৭

গত কয়েকবছর ভালো আয় করেছিলাম, পিতামাতার ভরনপোষণ স্বজনদের সাহায্য আমিই করতাম। এখন অনেকে – ইসলামে পিতামাতা ও স্বজনদের দায়িত্ব, ফজিলতের বর্ননা শুনিয়ে বিলাসী জীবনের জন্য ব্যয় করার তাগিত দেয়।

পিতামাতা ও স্বজনদের সাহায্য করা ফরজ। কিন্তু যারা চায় আমরা ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী পিতামাতা, স্বজনদের সেবা করি। অথচ তারাই ইসলামের নিয়ম মানেন না।

দাউদ (আঃ) ছিলেন সাম্রাজ্যের মালিক তবুও তার পুত্র সোলেমান (আঃ)-কে কি বিলীসিতা করিয়েছেন!! বরং তিনি সিয়াম পালন করতেন।

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে সবচেয়ে প্রিয় রোজা হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের রোজা। তিনি একদিন রোজা রাখতেন এবং একদিন বিনা রোজায় থাকতেন।’ (নাসাঈ, বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)

পৃথিবীতে কোন পিতা কি এমন আছে – রসুল (সাঃ) এর চেয়ে বেশি ভালোবাসতে পারে!! হজরত মিসওয়ার বিন মাখরামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ফাতেমা আমার কলিজার টুকরা, যে তাকে অসন্তুষ্ট করল সে আমাকে অসন্তুষ্ট করল। (বুখারী, খন্ড: ২য়, পৃ: ৫৩২, মুসলিম, খন্ড:২য়, পৃ: ২৯০)।

অথচ সেই ফাতেমা (রাঃ) রসুলল্লাহ’এর কাছে দাস চেয়েছিলেন রসুলুল্লাহ (সাঃ) তাকে তা দিয়ে দোয়া শিখিয়েছেন, যাতে নেক আমল অর্জন করতে পারেন। (বুখারী, মুসলিম)

কারণ তারা জানতো দুনিয়ার জীবন ক্ষনস্থায়ী, সুখ-দুঃখ সবই, আর জান্নাত চিরস্থায়ী।। এরপর জান্নাতে প্রিয় রব ও রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাক্ষাৎ লাভে পূর্ন সার্থকতা।

উম্মুল মুমেনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ওফাতের শেষ দিনগুলোতে হজরত ফাতেমাতুজ যাহরার কানে কানে কিছু গোপন কথা ব্যক্ত করেছেন। যা শুনার পর হজরত ফাতেমা ক্রন্দন করছেন, কিছুক্ষণ পর তিনি (ফাতেমা) মুচকি হাসি দিলেন। ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিলেন নবীজি কিছু দিনের মধ্যে ওফাত বরণ করবেন।
মুচকি হাসির কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, (হে ফাতেমা) তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তুমি হবে জান্নাতী নারীদের সরদার বা তুমি হবে সব মুমীন নারীদের সরদার। (বুখারী, খন্ড: ১ম, পৃ: ৫১২, মুসলিম, খন্ড:২, পৃ: ৫৯১)

মুমিনের ইচ্ছে হবে সেরকম – যে সে তার স্বজন, পিতামাতা নিয়ে চিরস্থায়ী জান্নাতে থাকবে। তাই দুনিয়ার বিলীসিতাকে ঘৃণা করবে।

পরিচিত বহু মুমিন ভাই আছে এমন – যাদের পরিবার তাদের ঈমান, আমলকে প্রাধান্য না দিয়ে দ্বীনের পথে হালাল চলার জন্য তাদের সাময়িক সংকটকে বড় করে দেখে।

একটু চিন্তা করুন – এই যুগে একজন মুমিন সন্তান পাওয়া কত না সৌভাগ্যের!! আর ঈমান ও আমল ঠিক রাখা মুমিনের জন্য কত না কষ্টের!!

মুমিন গান শুনতে চায় না তবুও গানের শব্দ তার কানে আসে। পার্ক ও সুন্দর পরিবেশে বসতে পারে না কারণ সর্বত্র জেনার ছড়াছড়ি, হালাল আয় করাটা কত না কষ্টের।

চারপাশে যখন তাকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয় দ্বীনে টিকে থাকতে, সেখানে গৃহের পরিবেশটাও তার বিপরীত হয় তখন তার জীবনটাই দুবির্ষহ লাগে।

তাই মুমিনের পথে বাঁধা না হয়ে তাকে উৎসাহ দেন হয়তো জান্নাতে উভয়ে সঙ্গী হবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *