রাসুল্লাল্লাহ (সা) সহীহ হাদীসের মাধ্যমে সংবাদ দিয়েছেন যে – ইয়াহূদীরা ৭১ দলে বিভক্ত হয়েছে, নাসারারা বিভক্ত হয়েছে ৭২ দলে, আর এ উম্মাতে মুহাম্মাদী বিভক্ত হবে ৭৩ দলে। একটি দল ব্যতীত সমস্ত দলই জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এটি হলো সেই দল, যারা নবী (সা) এবং তাঁর সাহাবীগণের সুন্নাহর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।
এ দলটি দুনিয়াতে বিদ‘আতে লিপ্ত হওয়া থেকে সুরক্ষিত থাকবে এবং পরকালে জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে। এটিই হলো সাহায্যপ্রাপ্ত দল, যা কিয়ামত পর্যন্ত হকের ওপর বিজয়ী থাকবে। (আবুদাউদ, তিরমিজি)।
ইয়াকুব (আঃ) এর উপাধি ছিল ইসরায়েল অর্থাৎ আল্লাহর বান্দা আর তার বংশধরদের বলা হতো বনী ইসরায়েল কিন্তু তাদের দ্বীন ছিল ইসলাম আর পরিচয় ছিল মুসলিম। এর পরবর্তীতে ইয়াকুব (আঃ) এর এক ছেলে ইয়াহুদের নাম অনুযায়ী নিজেদের পরিচয় দিতে থাকে ইয়াহুদী আস্তে আস্তে মুসলিম পরিচয় হারিয়ে গেল। বনী ইসরায়েল ও ইহুদিরা বহু দলে বিভক্ত হয় এবং প্রত্যেক দল একমাত্র নিজেদের হক্ব ও নাজাতপ্রাপ্ত ভাবতো।
একই পথে আমরা চলছি- রসুল, নবী ও সাহাবী আমাদের পরিচয় দিয়েছে মুসলিম কিন্তু আমরা বহু তরীকা, আলেমের অনুসরণ করতে গিয়ে দলে দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের আসল পরিচয় ভুলতে বসেছি। আর বেশিরভাগ দলই একমাত্র নিজেদের নাজাতপ্রাপ্ত ভাবে।
আল্লাহ বলেন –
ইহুদিরা বলে, “ইহুদি হয়ে যাও, তাহলে সঠিক পথ পেয়ে যাবে৷” খৃস্টানরা বলে, “খৃস্টান হয়ে যাও, তা হলে হিদায়াত লাভ করতে পারবে৷ ওদেরকে বলে দাও, “না, তা নয়; বরং এ সবকিছু ছেড়ে একমাত্র ইবরাহীমের পদ্ধতি অবলম্বন করো৷ আর ইবরাহীম মুশরিকদের অন্তরভুক্ত ছিল না।
সূরা বাকারা: ১৩৫
আরও বর্নিত আছে-
এবং জিহাদ কর আল্লাহর পথে যেভাবে জিহাদ করা উচিত। তিনি তোমাদিগকে মনোনিত করিয়াছেন। তিনি দীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেন নাই। ইহা তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের মিল্লাত। তিনি (আল্লাহ্) পূর্বে তোমাদের নামকরণ করিয়াছেন ‘মুসলিম’ এবং এই কিতাবেও।
সূরা হাজ্জ: ৭৮
অথচ ইয়াকুবের (আঃ) মৃত্যুর সময় নিজের পরিচয় দিয়েছে মুসলিম ও মুসলিম থাকার অঙ্গীকার নিয়েছিল।
কুরআনে বর্ণিত,
তোমরা কি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলে, যখন ইয়াকুব এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছিল? মৃত্যুকালে সে তার সন্তানদের জিজ্ঞেস করলো, আমার পর তোমরা কার বন্দেগী করবে? তারা সবাই জবাব দিল, আমরা সেই এক আল্লাহর বন্দেগী করবো, যাকে আপনি এবং আপনার পূর্বপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাক ইলাহ হিসেবে মেনে এসেছেন আর আমরা তাঁরই অনুগত মুসলিম৷
সূরা বাকারাহঃ ১৩৩
তেমনি প্রিয় রসুল (সাঃ), সাহাবী, তাবেয়ীরা নিজেদের মুসলিম পরিচয় নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন, কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর অন্যরা ভক্তির নাম দিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে যেমনটা বনী ইসরায়েল করেছিল।
আল্লাহ বলেন –
আর ইয়াহুদীরা বলে, ‘উযাইর আল্লাহর পুত্র’ এবং খ্রিষ্টানরা বলে, ‘মসীহ আল্লাহর পুত্র।’ এটা তাদের মুখের কথা মাত্র (বাস্তবে তা কিছুই নয়)। তারা তো তাদের মতই কথা বলছে, যারা তাদের পূর্বে অবিশ্বাস করেছে। আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন, তারা উল্টো কোনদিকে যাচ্ছে।
সুরা তওবাঃ ৩০
উযায়ের সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, ইয়াহুদীরা যখন তাওরাত হারিয়ে ফেলেছিল তখন উযায়ের সেটা তার মুখস্থ থেকে পুণরায় জানিয়ে দিয়েছিল। তাই তাদের মনে হলো যে, এটা আল্লাহর পুত্র হবে, না হয় কিভাবে এটা করতে পারল। [সা’দী; কুরতুবী; ইবন কাসীর]। এটা নিঃসন্দেহে একটি মিথ্যা কথা যে, উযায়ের তাদেরকে মূল তাওরাত তার মুখস্থ শক্তি দিয়ে এনে দিয়েছিল।
কারণ উযায়ের কোন নবী হিসেবেও আমাদের কাছে প্রমাণিত হয়নি। এর মাধ্যমে ইয়াহুদীরা তাদের হারিয়ে যাওয়া গ্রন্থের ধারাবাহিকতা প্রমাণ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা তাদের দাবী মাত্র। ঐতিহাসিকভাবে এমন কিছু প্রমাণিত হয়নি।
ঠিক তেমনি প্রথমে একদল আলী (রাঃ)-কে আল্লাহর রুপ দাবী করে বাড়াবাড়ি করলো নাউজুবিল্লাহ!! আবার আরেক দল ঈসা (আঃ) পরবর্তী সংসার বিরাগীদের মত মুরজিয়া আকীদা গ্রহন করে খ্রিস্টান পরিচয় গ্রহন করলো। বর্তমানে অধিকাংশ সুফিবাদই জেহাদ ভুলে সে পথ অনুসরণ করছে।
অথচ ঈসা (আঃ) এর পরিচয় ছিল মুসলিম।
আল্লাহ বলেন –
যখন ঈসা অনুভব করলো, ইসরাঈল কুফরী ও অস্বীকার করতে উদ্যেগী হয়েছে, সে বললো, ‘‘কে হবে আল্লাহর পথে আমার সাহায্যকারী? হাওয়ারীগণ বলল, আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী৷ আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি ৷ সাক্ষী থাকো, আমরা মুসলিম।
সূরা আল ইমরান: ৫২
একই পরিচয় অন্য নবীরা দিয়েছিল-
কুরআনে বর্নিত-
হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে রাজ্য দান করিয়াছ এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়াছ। হে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা! তুমিই ইহলোক ও পরলোকে আমার অভিভাবক। তুমি আমাকে মুসলিম হিসাবে মৃত্যু দাও এবং আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের আর্ন্তভুক্ত কর।
সূরা ইউসুফ: ১০১
মহান আল্লাহ বলেন,
(যাদুকরগণ ফিরআউনকে বলিল) তুমি তো আমাদিগকে শাস্তি দিতেছ শুধু এইজন্য যে, আমরা আমাদের প্রতিপালকের নির্দেশে ঈমান আনিয়াছি, যখন নিদর্শনসমূহ আমাদের নিকট আসিয়াছে। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদিগকে ধৈর্য্য দান কর এবং মুসলমানরূপে আমাদের মৃত্যু দাও।
সূরা আ’রাফঃ ১২৬
ইসলাম ধর্ম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারী হিসাবে আমাদের পরিচয় কি হবে? এ প্রশ্নের উত্তর স্বয়ং আল্লাহ বলেন,
হে ঈমানদারগণ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় করো৷ এবং তোমরা মুসলিম না হইয়া কোন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করিও না।
সূরা ইমরানঃ ১০২
বলঃ হে আহলে কিতাব! এসো এমন একটি কথার দিকে, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই ধরনের৷ তা হচ্ছেঃ আমরা আল্লাহ ছাড়া কারোর বন্দেগী ও দাসত্ব করবো না৷ তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবো না৷ আর আমাদের কেউ আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেও নিজের রব হিসেবে গ্রহন করবে না। যদি তারা এ দাওয়াত গ্রহণ করতে প্রস্তুত না হয়, তাহলে পরিষ্কার বলে দাওঃ ‘তোমরা সাক্ষী থাকো, আমরা অবশ্যই মুসলিম।
সূরা আল ইমরানঃ ৬৪
সেই ব্যক্তির কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম হবে যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, সৎ কাজ করলো এবং ঘোষণা করলো আমি মুসলমান৷
হা মীম আস্-সাজদাঃ ৩৩
বনী ইসরায়েল, ইহুদি, খ্রিস্টানরা কিতাবের উর্ধ্বে গিয়ে আলেমদের মতকে প্রাধান্য দিয়ে ধ্বংস হয়েছিল।
তারা আল্লাহ্ ব্যতীত তাদের পণ্ডিত ও সংসার-বিরাগিদেরকে তাদের রবরূপে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়াম-পুত্র মসীহকেও। অথচ এক ইলাহের ইবাদাত করার জন্যই তারা আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। তারা যে শরীক করে তা থেকে তিনি কত না পবিত্ৰ।
সুরা তওবাঃ ৩১
এই আয়াতে বলা হয় যে, ইয়াহুদী-নাসারাগণ তাদের আলেম ও যাজক শ্রেণীকে আল্লাহর পরিবর্তে রব ও মাবুদ সাব্যস্ত করে রেখেছে। অনুরূপ ঈসা আলাইহিস সালামকেও মা’বুদ মনে করে। তাকে আল্লাহর পুত্ৰ মনে করায় তাকে মা’বুদ সাব্যস্ত করার দোষে যে দোষী করা হয়, তার কারণ হল, তারা পরিষ্কার ভাষায় ওদের মা’বুদ না বললেও পূর্ণ আনুগত্যের যে হক বান্দার প্রতি আল্লাহর রয়েছে, তাকে তারা যাজক শ্রেণীর জন্যে উৎসর্গ রাখে। অর্থাৎ তারা যাজক শ্রেণীর আনুগত্য করে চলে; যতই তা আল্লাহর নির্দেশের বিরোধী হোক না কেন? বলাবাহুল্য পাদ্রী ও পুরোহিতগণের আল্লাহ বিরোধী উক্তি ও আমলের আনুগত্য করা তাদেরকে মা’বুদ সাব্যস্ত করার নামান্তর, আর এটি হল প্রকাশ্য কুফরী ও শির্ক।
আদী ইবন হাতেম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি গলায় একটি সোনার ক্রুশ নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসলাম।
তখন তিনি বললেনঃ
হে আদী, তোমার গলা থেকে এ মূর্তিটি (ক্রুস) সরিয়ে ফেল এবং তাকে সূরা আত-তাওবাহর এ আয়াতটি তেলাওয়াত করতে শুনলাম- “তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পণ্ডিত ও সংসার-বিরাগীদেরকে তাদের পালনকর্তারূপে গ্রহণ করেছে।”
আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল, আমরা তো তাদের ইবাদত করি না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তারা তোমাদের জন্য কোন কিছু হালাল করলে তোমরা সেটাকে হালাল মনে কর আর কোন কিছুকে হারাম করলে তোমরা সেটাকে হারাম হিসাবে গ্রহণ কর। [তিরমিযীঃ ৩০৯৫]
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, শরীআতের মাসায়েল সম্পর্কে অজ্ঞ জনসাধারণের পক্ষে ওলামায়ে কেরামের নির্দেশনার অনুসরণ বা ইজতিহাদী মাসায়েলের ক্ষেত্রে মুজতাহিদ ইমামগণের মতামতের অনুসরণ ততক্ষণই করতে পারবে যতক্ষণ না এর বিপরীতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল থেকে কোন কিছু প্রমাণিত হবে। যখনই কোন কিছু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মতের বিপক্ষে হয়েছে বলে প্রমাণিত হবে তখনি তা ত্যাগ করা ওয়াজিব। অন্যথায় ইয়াহুদী নাসারাদের মত হয়ে যাবে।
কারণ ইয়াহুদী-নাসারাগণ আল্লাহর কিতাব এবং আল্লাহর রাসূলের আদেশ নিষেধকে সম্পূর্ণ উপক্ষো করে স্বার্থপর আলেম এবং অজ্ঞ পুরোহিতদের কথা ও কর্মকে নিজেদের ধর্ম বানিয়ে নিয়েছে। আয়াতে তারই নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে।