আজ আমরা দলে দলে বিভক্ত, বড় বড় আকীদার ব্যাপার বাদ দিয়ে একে অপরকে তাকফীর করায় ব্যস্ত।
দেওবন্দ – উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে এই মাদ্রাসার অবস্থান। ১৮৬৬ সালে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ইসলামি পণ্ডিত এটির প্রতিষ্ঠা করেন। মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবি তাদের প্রধান ছিলেন। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন মাওলানা রশীদ আহমেদ গাঙ্গুহী ও সৈয়দ আবিদ হুসাইন।
তার মানে ১৮৬৬ সালের আগে কাউকে দেওবন্দী বলা হতো না।
বেরেলভী – নামটি উত্তর ভারতের শহর বেরেলি থেকে। যেটি আহমদ রেজা খানের (১৮৫৬-১৯২১) জন্মস্থান। যদিও বেরেলভী সাধারণভাবে ব্যবহৃত শব্দ, আন্দোলনটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত-এর শিরোনাম দ্বারাও পরিচিত (উর্দু: اهل سنت وجماعت)। সুন্নি সম্প্রদায়ের জন্য ফকিহ নাম, একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ের পরিবর্তে মূলধারার সুন্নি হিসেবে তাদের আত্ম-উপলব্ধির উল্লেখ। এর অনুসারীদের কাছে আন্দোলন হচ্ছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত, অথবা “ঐতিহ্য ও সম্প্রদায়ের মানুষ” এবং তারা নিজেদেরকে সুন্নি বলে উল্লেখ করে।
১৯০০ সালে বা তার আগে কারো পরিচয় বেরলভি’ ছিলো না।
আহলে হাদীস – পরিভাষাটি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. এর হাত ধরেই উৎপত্তি লাভ করে। এর পূর্বে হুবহু এ শব্দটির ব্যবহার তেমন পাওয়া যায় না। অবশ্য অনকের মতে আহলে হাদীস শব্দের সমর্থক শব্দের ব্যবহার এর পূর্বের যুগেও লক্ষ্য করা যায়। নবম শতাব্দিতে শাসক মামুনুর রশীদের রাজত্বে যখন কুরআন আল্লাহর সৃষ্টি কি সৃষ্টি নয়- এ দ্বন্দ্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠে তখন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল স্বোচ্ছার হোন। এবং তার তখন থেকেই আহলুল হাদীস শব্দটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় উঠে আসে। ফলে শব্দটি একটি পারিভাষিক রূপ পরিগ্রহ করে।
তেমনিভাবে বিভিন্ন তরিকাসহ বিভিন্ন পরিচয় সাহাবীদের যুগে ছিলো না। পূর্ববর্তী নবীগণ ও সাহাবীরা নিজেদের মুসলিম হিসেবে পরিচিতি দিতেন।
ইয়াকুব (আঃ) এর উপাধি ছিল ইসরায়েল অর্থাৎ আল্লাহর বান্দা আর তার বংশধরদের বলা হতো বনী ইসরায়েল। কিন্তু তাদের দ্বীন ছিল ইসলাম আর পরিচয় ছিল মুসলিম। এর পরবর্তীতে ইয়াকুব (আঃ) এর এক ছেলে ইয়াহুদের নাম অনুযায়ী নিজেদের পরিচয় দিতে থাকে ইয়াহুদী। আস্তে আস্তে মুসলিম পরিচয় হারিয়ে গেল। বনী ইসরায়েল ও ইহুদিরা বহু দলে বিভক্ত হয় এবং প্রত্যেক দল একমাত্র নিজেদের হক্ব ও নাজাতপ্রাপ্ত ভাবতো।
একই পথে আমরা চলছি- রসুল, নবী ও সাহাবী আমাদের পরিচয় দিয়েছে মুসলিম কিন্তু আমরা বহু তরীকা, আলেমের অনুসরণ করতে গিয়ে দলে দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের আসল পরিচয় ভুলতে বসেছি। আর বেশিরভাগ দলই একমাত্র নিজেদের নাজাতপ্রাপ্ত ভাবে।
আল্লাহ বলেন –
"ইহুদিরা বলে, “ইহুদি হয়ে যাও, তাহলে সঠিক পথ পেয়ে যাবে৷” খৃস্টানরা বলে, “খৃস্টান হয়ে যাও, তা হলে হিদায়াত লাভ করতে পারবে৷ ওদেরকে বলে দাও, “না, তা নয়; বরং এ সবকিছু ছেড়ে একমাত্র ইবরাহীমের পদ্ধতি অবলম্বন করো৷ আর ইবরাহীম মুশরিকদের অন্তরভুক্ত ছিল না।" (সূরা বাকারা: ১৩৫)
আরও বর্নিত আছে-
"এবং জিহাদ কর আল্লাহর পথে যেভাবে জিহাদ করা উচিত। তিনি তোমাদিগকে মনোনিত করিয়াছেন। তিনি দীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেন নাই। ইহা তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের মিল্লাত। তিনি (আল্লাহ্) পূর্বে তোমাদের নামকরণ করিয়াছেন ‘মুসলিম’ এবং এই কিতাবেও।" (সূরা হাজ্জ: ৭৮)
অথচ ইয়াকুবের (আঃ) মৃত্যুর সময় নিজের পরিচয় দিয়েছে মুসলিম ও মুসলিম থাকার অঙ্গীকার নিয়েছিল।
কুরআনে বর্ণিত,
"তোমরা কি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলে, যখন ইয়াকুব এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছিল? মৃত্যুকালে সে তার সন্তানদের জিজ্ঞেস করলো, আমার পর তোমরা কার বন্দেগী করবে? তারা সবাই জবাব দিল, আমরা সেই এক আল্লাহর বন্দেগী করবো, যাকে আপনি এবং আপনার পূর্বপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাক ইলাহ হিসেবে মেনে এসেছেন আর আমরা তাঁরই অনুগত মুসলিম৷" (সূরা বাকারাহঃ ১৩৩)
তেমনি প্রিয় রসুল (সাঃ), সাহাবী, তাবেয়ীরা নিজেদের মুসলিম পরিচয় নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর অন্যরা ভক্তির নাম দিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে যেমনটা বনী ইসরায়েল করেছিল।
আল্লাহ বলেন –
"আর ইয়াহুদীরা বলে, ‘উযাইর আল্লাহর পুত্র’ এবং খ্রিষ্টানরা বলে, ‘মসীহ আল্লাহর পুত্র।’ এটা তাদের মুখের কথা মাত্র (বাস্তবে তা কিছুই নয়)। তারা তো তাদের মতই কথা বলছে, যারা তাদের পূর্বে অবিশ্বাস করেছে। আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন, তারা উল্টো কোনদিকে যাচ্ছে।" (সুরা তওবাঃ ৩০)
উযায়ের সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, ইয়াহুদীরা যখন তাওরাত হারিয়ে ফেলেছিল তখন উযায়ের সেটা তার মুখস্থ থেকে পুণরায় জানিয়ে দিয়েছিল। তাই তাদের মনে হলো যে, এটা আল্লাহর পুত্র হবে, না হয় কিভাবে এটা করতে পারল। [সা’দী; কুরতুবী; ইবন কাসীর]। এটা নিঃসন্দেহে একটি মিথ্যা কথা যে, উযায়ের তাদেরকে মূল তাওরাত তার মুখস্থ শক্তি দিয়ে এনে দিয়েছিল।
কারণ উযায়ের কোন নবী হিসেবেও আমাদের কাছে প্রমাণিত হয়নি। এর মাধ্যমে ইয়াহুদীরা তাদের হারিয়ে যাওয়া গ্রন্থের ধারাবাহিকতা প্রমাণ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা তাদের দাবী মাত্র। ঐতিহাসিকভাবে এমন কিছু প্রমাণিত হয়নি।
ঠিক তেমনি প্রথমে একদল আলী (রাঃ)-কে আল্লাহর রূপ দাবী করে বাড়াবাড়ি করলো নাউজুবিল্লাহ!! আবার আরেক দল ঈসা (আঃ) পরবর্তী সংসার বিরাগীদের মত মুরজিয়া আকীদা গ্রহণ করে খ্রিস্টান পরিচয় গ্রহণ করলো। বর্তমানে অধিকাংশই জেহাদ ভুলে সে পথ অনুসরণ করছে।
অথচ ঈসা (আঃ) এর পরিচয় ছিল মুসলিম।
আল্লাহ বলেন –
"যখন ঈসা অনুভব করলো,তারা (বনী ইসরাঈল) কুফরী ও অস্বীকার করতে উদ্যেগী হয়েছে, সে বললো, ‘‘কে হবে আল্লাহর পথে আমার সাহায্যকারী? হাওয়ারীগণ বলল, আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী৷ আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি ৷ সাক্ষী থাকো, আমরা মুসলিম।" (সূরা আল ইমরান: ৫২)
একই পরিচয় অন্য নবীরা দিয়েছিল।
কুরআনে বর্নিত-
“হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে রাজ্য দান করিয়াছ এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়াছ। হে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা! তুমিই ইহলোক ও পরলোকে আমার অভিভাবক। তুমি আমাকে মুসলিম হিসাবে মৃত্যু দাও এবং আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের আর্ন্তভুক্ত কর।” (সূরা ইউসুফ: ১০১)
মহান আল্লাহ বলেন,
“(যাদুকরগণ ফিরআউনকে বলল) তুমি তো আমাদিগকে শাস্তি দিচ্ছ শুধু এইজন্য যে, আমরা আমাদের প্রতিপালকের নির্দেশে ঈমান এনেছি, যখন নিদর্শনসমূহ আমাদের নিকট এসেছে। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদিগকে ধৈর্য্য দান কর এবং মুসলমানরূপে আমাদের মৃত্যু দাও।” (সূরা আ’রাফঃ ১২৬)
আমরা ঐক্য চাই অথচ বিভিন্ন নামে ও দলে বিভক্ত। অথচ খলিফা মাহাদী ও ঈসা (আঃ) এর সময় গাছ ও পাথর বলবে – হে মুসলিম! ও আবদু্ল্লাহ (আল্লাহর বান্দা) আমার পিছে ইয়াহুদী লুকিয়ে আছে। (মুসলিম শরীফ)।
বিভিন্ন ঈমাম ও আলেমদের মাধ্যমে আমরা দ্বীনের অনেক কিছু জানতে পেরেছি আর তাদের কথা রসুলুল্লাহ (সা) ও সাহাবীদের আর্দশের সাথে মিলে যাচ্ছে তাই মানছি। এর অর্থ এই নয় কেউ শুধু ঈমামদের পথের অনুসারী। বরং রসুলুল্লাহর (সাঃ) পথের অনুসারী যা ঈমামগন রসুলের (সাঃ) সুন্নাহ হতে জানিয়েছেন।
তেমনি সহীহ সিত্তাহের হাদীসের ব্যাপারে ঐক্যমত আছে- অনেক কিছুই ঈমাম বুখারী, মুসলিম হতে জেনেছে। আজ পর্যন্ত শুনেছেন কেউ পরিচয় দেয় আমি বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী মাজহাবের অনুসারী বরং যারা সব সহীহ হাদীস মেনে চলে তারাই মুসলিম।
ঈমাম ও আলেমগণ হলো জানার মাধ্যম যার ভিত্তিতে রসুলের (সাঃ) সুন্নাহ জানা হয়, যা মিলল তা মানলে রসুলের (সাঃ) সুন্নাহ, বা পথ মানা হয়।