আমাদের চারপাশে মানুষগুলো কেউ শতভাগ দোষ, ক্রুটি মুক্ত নয়। মুমিনের ভুল হলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই বাহ্যিক দেখে মানুষের অন্তরের সম্পূর্ণ ধারণা পাওয়া যায় না। তবে কুফর, শিরকের কোনরূপ সাহায্য মুমিন করতে পারে না, তা সম্মুখে বা গোপনে হোক।
অদ্ভুত এক পরিবেশ!! কেউ ইসলাম কায়েম করতে চায় অথচ ইসলাম অর্থ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ, সকল প্রকার শিরক, কুফর বর্জন করা এটাই আজও বুঝে না।
তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটে তাগুতদের সাথে, তাদের সঙ্গ, আদেশ, অনুরোধ যতটা প্রিয় ও গুরুত্ব পায় ততটা ইসলাম ও দ্বীনী ভাইদেরটা গুরুত্ব পায় না।
হাদীসে এসেছে, আল্লাহর অবাধ্যতা করে কোন মানুষের আনুগত্য করা বৈধ নয়। [মুসনাদে আহমাদ]
আল্লাহ বলেন-
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের পিতৃবর্গ ও ভাতৃবৃন্দ যদি ঈমানের মুকাবিলায় কুফরীকে পছন্দ করে, তবে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমাদের মধ্যে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারাই যালিম।
সুরা তওবা-২৩
অনেকে জেহাদের দাওয়াত দেন অথচ সুদ ত্যাগ করতে রাজি নয়! সুদের বাড়িতে বসবাস, সুদের ব্যবসা চলমান অথবা কোনভাবে সুদী সাহায্য করে যাচ্ছে।
সুদখোর স্বয়ং আল্লাহ ও রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা বকেয়া আছে তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মুমিন হও। যদি তোমরা না করো (সুদের বকেয়া না ছাড়ো, সুদের কারবার অব্যাহত রাখো) তবে আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও…।’
সুরা বাকারা, আয়াত: ২৭৮-২৭৯
হক্বপন্থী আলেমরা বলেন আল্লাহ যার ভালো চায়- নেককার লোকদের সঙ্গী করে দেন। যেমন- রসুলের (সা:) সঙ্গী ছিল সাহাবীরা (রা:) পরস্পর। তারা দুনিয়া ও জান্নাতের সঙ্গী।
অপরদিকে সবচেয়ে বড় অভিশাপের একটা হল- দ্বীনের পথ, দ্বীনের সাথীর মাঝে দূরত্ব বেড়ে যাওয়া আর কাফের, মুরতাদ, মুনাফেকদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা ও দীর্ঘসময় ওদের সাথে কাটানো। সাহাবীদের রসুল (সা:) ও পরস্পরের সাথে কিছু দিন বা কিছু সময়ের দূরত্বে অসহনীয় হয়ে উঠতো। বহু দ্বীনী সাথী বলেন – কারাগারের জুলুম, নির্যাতন অভাব থাকা স্বত্বেও তাদের কাছে কারগার মুক্ত জীবনের চেয়ে প্রিয় লাগে কারন মুনাফেক ও কুফর, শিরক হতে দূরে থেকে দ্বীনী ভাইদের সাথে ইবাদাতে পরম প্রশান্তি আসে। অথচ বহু দ্বীনের সঙ্গী আছে এমন – তারা মুমিন ও মুনাফেকের কাছে প্রিয় হতে চায় অথচ তা কেয়ামত পর্যন্ত অসম্ভব।
মুমিনের হৃদয়ে থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত আর মুনাফেকের শুধু দুনিয়াপ্রীতি যার সংস্পর্শে মুমিন ক্ষতিগ্রস্হ হতে পারে। সাহাবিদের কাছে রসুল (সা:) ও দ্বীনী ভাইদের সাথে দূরত্ব কতটা কষ্টকর ছিল।
আল্লাহ বলেন-
তোমরা তাদের কাছে ফিরে আসলে তারা তোমাদের কাছে অজুহাত পেশ করবে। বলুন, তোমরা অজুহাত পেশ করো না, আমরা তোমাদেরকে কখনো বিশ্বাস করবো না; অবশ্যই আল্লাহ আমাদেরকে তোমাদের খবর জানিয়ে দিয়েছেন এবং আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের কাজকর্ম দেখবেন এবং তার রাসুলও। তারপর গায়েব ও প্রকাশ্যের জ্ঞানীর কাছে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে এরপর তোমরা যা করতে, তা তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দেবেন।’
সুরা তওবা, আয়াত ৯৪
আয়াতের ব্যাখ্যায় এসেছে,
হজরত আবদুল্লাহ ইবনু কাব ইবনু মালিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহ বর্ণনা করেছেন, ‘আমি কাব ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলতে শুনেছি, তিনি যখন তাবুকের যুদ্ধে পিছনে রয়ে গেলেন, আল্লাহর কসম! তখন আল্লাহ আমাকে এমন এক নেয়ামত দান করেন যে মুসলিম হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এত বড় নেয়ামত পাইনি। তা হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সত্য কথা প্রকাশ করা। আমি তাঁর কাছে মিথ্যা বলিনি।
যদি মিথ্যা বলতাম, তবে অন্যান্য (মুনাফেক ও) মিথ্যাচারী যেভাবে ধ্বংস হয়েছে, আমিও সেভাবে ধ্বংস হয়ে যেতাম। যে সময় ওহি অবতীর্ণ হলো- ‘তারা তোমাদের সামনে কসম করবে যাতে তোমরা তাদের প্রতি রাজি হও। যদি তোমরা তাদের প্রতি রাজি হয়ে যাও তবুও আল্লাহ এসব ফাসিক লোকদের প্রতি রাজি হবেন না’ (সুরা বারাআত : ৯৬)।’ (বুখারি)
এ আয়াতে সেসব লোকদের কথা বলা হয়েছে, ‘যারা জেহাদ থেকে ফিরে আসার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে নিজেদের জেহাদে অংশগ্রহণ না করার পক্ষে মিথ্যা ওজর আপত্তি পেশ করছিল। আর এ আয়াতগুলো মদিনায় ফিরে আসার আগেই অবতীর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং তাতে পরবর্তী সময়ে সংঘটিত ঘটনার সংবাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, আপনি যখন মদিনায় ফিরে যাবেন, তখন মুনাফেকরা ওজর-আপত্তি নিয়ে আপনার কাছে আসবে।’
আর বাস্তবে এ ঘটনাই ঘটেছিল। এ আয়াতগুলোতে তাদের সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যখন এরা আপনার কাছে ওজর আপত্তি পেশ করার জন্য আসে, তখন আপনি তাদেরকে বলে দিন যে-
মিথ্যা ওজর পেশ করো না। আমরা তোমাদের কথাকে সত্য বলে স্বীকার করব না। কারণ, আল্লাহ তাআলা ওহির মাধ্যমে আমাদেরকে তোমাদের মনের গোপন ইচ্ছা জানিয়ে দিয়েছেন। ফলে তোমাদের মিথ্যাবদিতা আমাদের কাছে প্রকাশ হয়ে গেছে। কাজেই কোন রকম ওজর আপত্তি বর্ণনা করা অর্থহীন।
তবে এখনও অবকাশ রয়েছে যেন তারা মুনাফেকি পরিহার করে সত্যিকার মুসলিম হয়ে যায়। ফলে আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসুল তোমাদের কার্যকলাপ দেখবেন যে, তা কি এবং কোন ধরনের হয়। যদি তোমরা তওবা করে নিয়ে সত্যিকার মুসলিম হয়ে যাও, তবে সে অনুযায়ীই ব্যবস্থা করা হবে; তোমাদের পাপ মাফ হয়ে যাবে। অন্যথায় তা তোমাদের কোনো উপকারেই আসবে না। (তাবারি)
সুরা তওবার বাকি আয়াতের তেলাওয়াতে তওবা কবুল ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং তাঁদের জন্য জান্নাতের ঘোষণা আলোচিত হয়েছে। তবে শুরুতে মুনাফিকদের আলোচনা রয়েছে। যা আল্লাহ তাআলা বিশ্বনবিকে (সা) তাবুক অভিযান থেকে ফেরার পথে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, মদিনায় পৌঁছে মুনাফেকরা বিভিন্ন অজুহাত পেশ করবে। আর বাস্তবেই তাই ঘটেছিল। তারা মিথ্যা কসম খেয়ে নিজেদের স্বপক্ষে কথা বলছিল।
তাবুক যুদ্ধে না যাওয়া তিন সাহাবির সত্য বর্ণনা ও তওবা কবুল
আবার অলসতার কারণে তিনজন ঈমানদার সাহাবি তাবুক অভিযানে যেতে পারেনি। তারা বিশ্বনবির কাছে কোনো ওজর পেশ না করে সুস্পষ্টভাবে স্বীকার করেছে যে, কোনো ওজরের কারণে নয় বরং অলসতার কারণে তারা তাবুক অভিযানে অংশগ্রহণ করেনি।
তাদের অলসতার জন্য শাস্তিস্বরূপ তাদের ৫০ দিন বয়কট করে রাখা হয়। আবার সত্য প্রকাশে তাদের দেওয়া হয় বিশেষ পুরস্কার।
যে তিনজন প্রখ্যাত সাহাবি তাবুকের যুদ্ধে যাননি তাদের এই না যাওয়ার অপরাধ থেকে তারা কীভাবে তওবা করেছেন; দীর্ঘ এক হাদিসে তারই বর্ণনা পাওয়া যায়। সাহাবি কাব ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর ছেলে হজরত আবদুল্লাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, আমি (আমার বাবা) কাব ইবনু মালেককে ঐ ঘটনা বর্ণনা করতে শুনেছি-
যখন তিনি তাবুকের যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেছনে থেকে যান। তিনি বলেন, ‘আমি তাবুক যুদ্ধ ছাড়া যে যুদ্ধই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন তাতে কখনোই তাঁর পেছনে থাকিনি। (অবশ্য বদরের যুদ্ধ থেকে আমি পেছনে রয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বদরের যুদ্ধে যে অংশগ্রহণ করেনি, তাকে ভৎর্সনা করা হয়নি।) মূল কারণ ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলিমগণ কুরাইশদের কাফেলার পশ্চাদ্ধাবনে বের হয়েছিলেন। (শুরুতে যুদ্ধের নিয়ত ছিল না)। পরিশেষে আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে ও তাঁদের শত্রুকে (পূর্বঘোষিত) ওয়াদা ছাড়াই একত্রিত করেছিলেন।
আমি আক্বাবার রাতে (মিনায়) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে উপস্থিত ছিলাম, যখন আমরা ইসলামের উপর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম। আকাবার রাত অপেক্ষা আমার কাছে বদরের উপস্থিতি বেশি প্রিয় ছিল না। যদিও বদর (অভিযান) মানুষের কাছে ওর চেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ। (কাব বলেন) আর আমার তাবুকের যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেছনে থাকার ঘটনা এরূপ যে, এই যুদ্ধ থেকে পেছনে থাকার সময় আমি যতটা সমর্থ ও সচ্ছল ছিলাম অন্য কোনো সময় এমন ছিলাম না।
আল্লাহর কসম! এর আগে আমার কাছে কখনো দুইটি সওয়ারি (বাহন) একত্রিত হয়নি। কিন্তু এই (যুদ্ধের) সময়ে একই সঙ্গে দুইটি সওয়ারি আমার কাছে মজুদ ছিল।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিয়ম ছিল, যখন তিনি কোনো যুদ্ধে বের হওয়ার ইচ্ছা করতেন, তখন ‘তাওরিয়া’ করতেন (তাওরিয়া হলো- সফরের গন্তব্যস্থলের নাম গোপন রেখে সাধারণ অন্য স্থানের নাম নিতেন, যাতে শত্রুরা টের না পায়)। এই যুদ্ধ এভাবে চলে এল।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভীষণ গরমে এই যুদ্ধে বের হলেন এবং দূরের সফর ও দীর্ঘ মরুভূমির সম্মুখীন হলেন। আর বহু সংখ্যক শত্রুরাও সম্মুখীন হলেন। এই জন্য তিনি মুসলিমদের সামনে বিষয়টি স্পষ্ট করে দিলেন; যাতে তাঁরা সেই অনুযায়ী যথাযথ প্রস্তুতি নেন। ফলে তিনি সেই দিকও বলে দিলেন, যেদিকে যাবার ইচ্ছা করেছেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে অনেক মুসলিম ছিলেন এবং তাদের কাছে কোনো হাজিরা খাতা ছিল না, যাতে তাদের নামসমূহ লেখা হবে। এই জন্য যে ব্যক্তি (যুদ্ধে) অনুপস্থিত থাকতো সে এই ধারণাই করত যে, আল্লাহর ওহি অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া তার অনুপস্থিতির কথা গুপ্ত থাকবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই যুদ্ধ ফল পাকার মৌসুমে করেছিলেন এবং সে সময় (গাছের) ছায়াও উৎকৃষ্ট (ও প্রিয়) ছিল, আর আমার টানও ছিল সেই ফল ও ছায়ার দিকে।
সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলিমরা (তাবুকের যুদ্ধের জন্য) প্রস্তুতি নিলেন। আর (আমার এই অবস্থা ছিল যে) আমি সকালে আসতাম, যেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে আমিও (যুদ্ধের) প্রস্তুতি নেই। কিন্তু কোনো ফয়সালা না করেই আমি (বাড়ী) ফিরে আসতাম এবং মনে মনে বলতাম যে, আমি যখনই ইচ্ছা করবো, যুদ্ধে শামিল হয়ে যাব। কেননা, আমি এর ক্ষমতা রাখি। আমার এই গড়িমসি অবস্থা অব্যাহত রইল এবং লোকেরা জেহাদের আয়োজনে প্রবৃত্ত থাকলেন।
এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলিমরা একদিন সকালে তাবুকের জেহাদে বেরিয়ে পড়লেন এবং আমি প্রস্তুতির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে পারলাম না। আমি আবার সকালে এলাম এবং বিনা সিদ্ধান্তেই (বাড়ী) ফিরে গেলাম।
সুতরাং আমার এই অবস্থা অব্যাহত থেকে গেল। ওদিকে মুসলিম সেনারা দ্রুতগতিতে আগে বাড়তে থাকলো এবং যুদ্ধের ব্যাপারও ক্রমশ এগুতে লাগলো। আমি ইচ্ছা করলাম যে, আমিও সফরে রওয়ানা হয়ে তাদের সঙ্গ পেয়ে যাই। হায়! যদি আমি তাই করতাম (তাহলে কতই না ভালো হত)! কিন্তু এটা আমার ভাগ্যে হয়ে উঠলো না।
এদিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চলে যাওয়ার পর যখনই আমি লোকের মাঝে আসতাম, তখন এ জন্যই দুঃখিত ও চিন্তিত হতাম যে, এখন (মদিনায়) আমার সামনে কোনো আদর্শ আছে তো কেবলমাত্র মুনাফেক কিংবা এত দুর্বল ব্যক্তিরা যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমাযোগ্য বা অপারগ বলে গণ্য করেছেন।
পুরো রাস্তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে আমাকে স্মরণ করলেন না। তাবুক পৌঁছে যখন তিনি লোকের মাঝে বসেছিলেন, তখন আমাকে স্মরণ করলেন এবং বললেন, ‘কাব ইবনু মালেকের কী হয়েছে?’
বানু সালেমাহ (গোত্রের) একটি লোক বলে উঠল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! তার দুই চাদর এবং দুই পার্শ্ব দর্শন (অর্থাৎ ধন ও তার অহঙ্কার) তাকে আঁটকে দিয়েছে।’ (এ কথা শুনে) মুআয ইবনু জাবাল বললেন, ‘বাজে কথা বললে তুমি। আল্লাহর কসম, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা তার ব্যাপারে ভালো ছাড়া অন্য কিছু জানি না।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নীরব থাকলেন।
এসব কথাবার্তার মাঝে তিনি দেখলেন, সাদা পোশাক পরে (মরুভূমির) মরীচিকা ভেদ করে এক লোক আসছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তুমি যেন আবু খাইসামাহ হও।’ (দেখা গেল) সত্যিকারে তিনি আবু খাইসামাহ আনসারিই ছিলেন। আর তিনি সেই ব্যক্তি ছিলেন, যিনি একবার আড়াই কিলো খেজুর সাদাকাহ করেছিলেন বলে মুনাফেকরা (তা অল্প মনে করে) তাঁকে বিদ্রুপ করেছিল।’
কাব বলেন, ‘এরপর যখন আমি সংবাদ পেলাম যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাবুক থেকে ফেরার সফর শুরু করে দিয়েছেন, তখন আমার মনে কঠিন দুশ্চিন্তা এসে উপস্থিত হলো এবং মিথ্যা অজুহাত পেশ করার চিন্তা করতে লাগলাম এবং মনে মনে বলতে লাগলাম যে, আগামীকাল যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরবেন, সে সময় আমি তাঁর জবাবদিহিতা থেকে বাঁচব কী উপায়ে?
আর এ ব্যাপারে আমি পরিবারের প্রত্যেক বুদ্ধিমান মানুষের সহযোগিতা চাইতে লাগলাম। এরপর যখন বলা হলো যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন একদম কাছাকাছি, তখন আমার অন্তর থেকে বাতিল (পরিকল্পনা) দূর হয়ে গেল। এমনকি আমি বুঝতে পারলাম যে, মিথ্যা বলে আমি কখনোই বাঁচতে পারব না। সুতরাং আমি সত্য বলার দৃঢ় সংকল্প করে নিলাম।
এদিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকালে (মদিনায়) পদার্পণ করলেন। তাঁর অভ্যাস ছিল, যখন তিনি সফর থেকে (বাড়ি) ফিরতেন, তখন সর্বপ্রথম তিনি মাসজিদে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন। তারপর (সফরের বিশেষ বিশেষ খবর শোনাবার জন্য) লোকেদের জন্য বসতেন।
সুতরাং এই সফর থেকে ফিরেও যখন আগের মতো কাজ করলেন, তখন মুনাফেকরা এসে তাঁর কাছে ওজর-আপত্তি পেশ করতে লাগল এবং কসম খেতে আরম্ভ করলো। এরা সংখ্যায় আশি জনের কিছু বেশি ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বাহ্যিক ওজর গ্রহণ করে নিলেন, তাদের বায়আত নিলেন, তাদের জন্য (আল্লাহর কাছে) ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং তাদের গোপনীয় অবস্থা আল্লাহকে সঁপে দিলেন। অবশেষে আমিও তাঁর কাছে হাজির হলাম।
এরপর যখন আমি তাঁকে সালাম দিলাম, তখন তিনি রাগান্বিত ব্যক্তির হাসির মতো মুচকি হাসলেন। এরপর তিনি বললেন, ‘সামনে এসো!’ আমি তাঁর সামনে এসে বসে পড়লাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কেন জেহাদ থেকে পেছনে রয়ে গেলে? তুমি কি বাহন ক্রয় করনি?’
আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর কসম! আমি যদি আপনি ছাড়া দুনিয়ার অন্য কোনো লোকের কাছে বসতাম, তাহলে নিশ্চিতভাবে কোনো মিথ্যা ওজর পেশ করে তার অসন্তুষ্টি থেকে বেঁচে যেতাম। বাকচাতুর্য বা তর্ক-বিতর্ক করার অভিজ্ঞতা আমার যথেষ্ট রয়েছে।
কিন্তু আল্লাহর কসম! আমি জানি, যদি আপনার সামনে মিথ্যা বলি, যাতে আপনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন; তাহলে অতি সত্বর আল্লাহ তাআলা (ওহির দ্বারা) আপনাকে আমার উপর অসন্তুষ্ট করে দেবেন।
পক্ষান্তরে আমি যদি আপনাকে সত্য কথা বলি, তাহলে আপনি আমার উপর অসন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু আমি আল্লাহর কাছে এর সুফলের আশা রাখি। (সেহেতু আমি সত্য কথা বলছি যে,) আল্লাহর কসম! (আপনার সঙ্গে জেহাদে যাওয়ার ব্যাপারে) আমার কোনো অসুবিধা ছিল না। আল্লাহর কসম! আপনার সঙ্গ ছেড়ে পেছনে থাকার সময় আমি যতটা সমর্থ ও সচ্ছল ছিলাম ততটা কখনো ছিলাম না।’
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘এ লোকটি নিশ্চিতভাবে সত্য কথা বলেছে। বেশ, তুমি এখান থেকে চলে যাও, যে পর্যন্ত তোমার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা কোন ফায়সালা না করবেন।’
আমার পেছনে পেছনে বানু সালামাহ (গোত্রের) কিছু লোক এল এবং আমাকে বলল যে, ‘আল্লাহর কসম! আমরা অবগত নই যে, তুমি এর আগে কোনো পাপ করেছ কিনা। অন্যান্য পেছনে থেকে যাওয়া লোকেদের ওজর পেশ করার মতো তুমিও কোনো ওজর পেশ করলে না কেন?
তোমার পাপ মোচনের জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমার জন্য (আল্লাহর কাছে) ক্ষমা প্রার্থনা করতেন।’
কাব বললেন, ‘আল্লাহর কসম! লোকেরা আমাকে আমার সত্য কথা বলার জন্য তিরস্কার করতে থাকলো।
আবার আমি তাদেরকে বললাম, ‘আমার এ ঘটনা কি অন্য কারো সঙ্গে ঘটেছে?’ তাঁরা বললেন, ‘হ্যাঁ’; তোমার মতো আরো দুই জন সমস্যায় পড়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তারাও সেই কথা বলেছে, যা তুমি বলেছ এবং তাদেরকে সেই একই কথা বলা হয়েছে; যা তোমাকে বলা হয়েছে।’
আমি তাদের কাছে জানতে চাইলাম, ‘তারা দুই জন কে কে?’
তারা বললো, ‘মুরারাহ ইবনু রাবী আমরি ও হিলাল ইবনু উমাইয়্যাহ ওয়াকিফি।’
এই দুইজন যাঁদের কথা তারা আমার কাছে বর্ণনা করলো; তাঁরা সৎলোক ছিলেন এবং বদর যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন; তাঁদের মধ্যে আমার জন্য আদর্শ ছিল। যখন তারা সে দুইজন ব্যক্তির কথা বললো, তখন আমি আমার আগের অবস্থার (সত্যের) উপর অনড় থেকে গেলাম। (এরপর) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকেদেরকে পেছনে অবস্থানকারীদের মধ্যে আমাদের তিনজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে নিষেধ করে দিলেন।’
কাব বললেন, ‘লোকেরা আমাদের থেকে পৃথক হয়ে গেলো।’ অথবা বললেন, ‘লোকেরা আমাদের জন্য পরিবর্তন হয়ে গেলো। পরিশেষে পৃথিবী আমার জন্য আমার অন্তরে অপরিচিত মনে হতে লাগল। যেন এটা সেই পৃথিবী নয়, যা আমার পরিচিত ছিল। আমার দুই সঙ্গীরা তো নরম হয়ে ঘরের মধ্যে কান্নাকাটি আরম্ভ করে দিলেন। কিন্তু আমি গোত্রের মধ্যে সবচেয়ে যুবক ও বলিষ্ঠ ছিলাম। ফলে আমি ঘর থেকে বের হয়ে মুসলিমদের সঙ্গে নামাজে হাজির হতাম এবং বাজারসমূহে ঘোরাফেরা করতাম। কিন্তু কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতো না।
আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে যেতাম এবং তিনি যখন নামাজের পর বসতেন, তখন তাঁকে সালাম দিতাম, আর আমি মনে মনে বলতাম যে, তিনি আমার সালামের উত্তর দিতে ঠোঁট নাড়াচ্ছেন কিনা? তারপর আমি তাঁর কাছে নামাজ পড়তাম এবং আড়চোখে তাঁকে দেখতাম।
(দেখতাম) যখন আমি নামাজে মনোযোগী হচ্ছি, তখন তিনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন এবং যখন আমি তাঁর দিকে দৃষ্টি ফিরাচ্ছি, তখন তিনি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন!
অবশেষে যখন আমার সঙ্গে মুসলিমদের বিমুখতা দীর্ঘ হয়ে গেল, তখন একদিন আমি আবু কাতাদার বাগানে দেয়াল ডিঙ্গিয়ে (তাতে প্রবেশ করলাম।) সে (আবু কাতাদাহ) আমার চাচাতো ভাই এবং আমার সর্বাধিক প্রিয় লোক ছিল। আমি তাকে সালাম দিলাম।
কিন্তু আল্লাহর ক্বসম! সে আমাকে সালামের জওয়াব দিল না। আমি তাকে বললাম, ‘হে আবু ক্বাতাদাহ! আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করছি, তুমি কি জান যে, আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলকে ভালোবাসি?’
সে নিরুত্তর থাকল। আমি দ্বিতীয়বার কসম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। এবারেও সে চুপ থাকল। আমি তৃতীয়বার কসম দিয়ে প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলে সে বলল, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই বেশি জানেন।’
এ কথা শুনে আমার দুই চোখ থেকে পানি ঝরতে লাগলো এবং যেভাবে গিয়েছিলাম, আমি সেভাবেই দেয়াল ডিঙ্গিয়ে ফিরে এলাম। এরই মধ্যে একদিন মদিনার বাজারে হাঁটছিলাম।
এমন সময় শাম দেশের কৃষকদের মধ্যে একজন কৃষককে বলতে শুনালাম, (যে মদিনায় খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করতে এসেছিল) কে আমাকে কাব ইবনু মালেককে দেখিয়ে দেবে?
লোকেরা আমার দিকে ইঙ্গিত করতে লাগলেন।
ফলে সে ব্যক্তি আমার কাছে এসে আমাকে ‘গাসসান’-এর বাদশার একখানি পত্র দিল। আমি লেখা-পড়া জানতাম, তাই আমি পত্রখানি পড়লাম। পত্রে লিখা ছিল-
‘এরপর আমরা এই সংবাদ পেয়েছি যে, আপনার সঙ্গী (মুহাম্মাদ) আপনার প্রতি দুর্ব্যবহার করেছে। আল্লাহ আপনাকে লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত অবস্থায় থাকার জন্য সৃষ্টি করেননি। আপনি আমাদের কাছে চলে আসুন; আমরা আপনার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করব।’
পত্র পড়ে আমি বললাম, ‘এটাও অন্য এক বালা (পরীক্ষা)।’
সুতরাং আমি ওটাকে চুলোয় ফেলে জ্বালিয়ে দিলাম।
এরপর যখন ৫০ দিনের মধ্যে ৪০ দিন গত হয়ে গেল এবং ওহি আসা বন্ধ ছিল। এই অবস্থায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন দূত আমার কাছে এসে বললো, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাকে তোমার স্ত্রী থেকে পৃথক থাকার আদেশ দিচ্ছেন!’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি কি তাকে তালাক দেব, না কী করব?’
সে বলল, ‘তালাক নয় বরং তার কাছ থেকে আলাদা থাকবে, মোটেই ওর কাছাকাছি হবে না।’
আমার দুই সঙ্গীর কাছেও এই বার্তা পৌঁছে দিলেন।
আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, ‘তুমি তোমার বাবার বাড়ি চলে যাও এবং সেখানে অবস্থান কর; যে পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে কোনো ফায়সালা না করেন।’
(আমার সঙ্গী দুইজনের মধ্যে একজন সঙ্গী) হিলাল ইবনু উমাইয়ার স্ত্রী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! হিলাল ইবনু উমাইয়াহ খুবই বৃদ্ধ মানুষ, তার কোনো খাদেমও নেই, সেহেতু আমি যদি তার খেদমত করি, তবে আপনি কি এটা অপছন্দ করবেন?’
তিনি বললেন, ‘না, (অর্থাৎ তুমি তার খেদমত করতে পার।) কিন্তু সে যেন (মিলনের উদ্দেশে) তোমার কাছাকাছি না হয়।’ (হিলালের স্ত্রী বললো, ‘আল্লাহর কসম! (দুঃখের কারণে এ ব্যাপারে) তার কোনো সক্রিয়তা নেই। আল্লাহর কসম! যখন থেকে এ ব্যাপার ঘটেছে তখন থেকে আজ পর্যন্ত সে সর্বদা কাঁদছে।’
কাব বললেন, ‘আমাকে আমার পরিবারের কিছু লোক বললেন যে, ‘তুমিও যদি নিজ স্ত্রীর ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অনুমতি চাইতে, (তাহলে তো তোমার জন্য ভালো হত।) তিনি হিলাল ইবনু উমাইয়ার স্ত্রীকে তো তার খেদমত করার অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন।’
আমি বললাম, ‘এ ব্যাপারে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অনুমতি চাইবো না। জানি না, যখন আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অনুমতি চাইবো, তখন তিনি কী বলবেন। কারণ, আমি তো যুবক মানুষ।’
এভাবে আরও দশদিন কেটে গেলো। যখন থেকে লোকেদের আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে নিষেধ করা হয়েছে, তখন থেকে এ পর্যন্ত আমাদের পঞ্চাশ রাত পূর্ণ হয়ে গেলো। আমি পঞ্চাশতম রাতে আমাদের এক ঘরের ছাদের উপর ফজরের নামাজ পড়লাম।
নামাজ পড়ার পর আমি এমন অবস্থায় বসে আছি যার বর্ণনা আল্লাহ তাআলা আমাদের ব্যাপারে দিয়েছেন। আমার জীবন আমার জন্য দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল এবং পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও আমার প্রতি সংকীর্ণ হয়ে উঠেছিল। এমন সময় আমি এক চিৎকারকারীর আওয়াজ শুনতে পেলাম।
সে সালআ পাহাড়ের উপর চড়ে উচ্চঃস্বরে বলছে, ‘হে কাব ইবনু মালিক! তুমি সুসংবাদ নাও!’
আমি তখন (খুশিতে শুকরিয়ার) সাজদায় পড়ে গেলাম এবং বুঝতে পারলাম যে, (আল্লাহর পক্ষ থেকে) মুক্তি এসেছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাজ পড়ার পর লোকেদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহ তাআলা আমাদের তওবা কবুল করে নিয়েছেন।
সুতরাং লোকেরা আমাদেরকে সুসংবাদ দেয়ার জন্য আসতে আরম্ভ করল। এক ব্যক্তি আমার দিকে অতি দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে এল। সে ছিল আসলাম (গোত্রের) এক ব্যক্তি। আমার দিকে সে দৌঁড়ে এল এবং পাহাড়ের উপর চড়ে (আওয়াজ দিল)। তার আওয়াজ ঘোড়ার চেয়েও দ্রুতগামী ছিল।
সুতরাং যখন সে আমার কাছে এল, যার সুসংবাদের আওয়াজ আমি শুনেছিলাম, তখন আমি তার সুসংবাদ দানের বিনিময়ে আমার দেহ থেকে দুইখানি বস্ত্র খুলে তাকে পরিয়ে দিলাম।
আল্লাহর কসম! সে সময় আমার কাছে এ দুইটি ছাড়া আর কিছু ছিল না। আর আমি নিজে দুইখানি কাপড় অস্থায়ীভাবে ধার নিয়ে পরলাম এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। পথে লোকেরা দলে দলে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমাকে মোবারকবাদ জানাতে লাগলেন এবং বলতে লাগলো, ‘আল্লাহ তাআলা তোমার তওবা কবুল করেছেন; তাই তোমাকে ধন্যবাদ।’
এরপর আমি মাসজিদে প্রবেশ করলাম। (দেখলাম) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বসে আছেন এবং তাঁর চারপাশে লোকজন আছে। ত্বালহা ইবনু উবাইদুল্লাহ উঠে ছুটে এসে আমার সঙ্গে মুসাফাহা করলেন এবং আমাকে মোবারকবাদ জানালেন। আল্লাহর কসম! মুহাজিরদের মধ্যে তিনি ছাড়া আর কেউ উঠলেন না।’
সুতরাং কাব ইননে মালিক কখনো তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহর এই ব্যবহার ভুলতেন না। কাব বললেন, ‘যখন আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সালাম জানালাম, তখন তিনি তাঁর খুশীময় উজ্জ্বল চেহারা নিয়ে আমাকে বললেন-
‘তোমার মা তোমাকে যখন প্রসব করেছে, তখন থেকে তোমার জীবনের বিগত সর্বাধিক শুভদিনের সুসংবাদ তুমি গ্রহণ কর!’
আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এই শুভসংবাদ আপনার পক্ষ থেকে, নাকি আল্লাহর পক্ষ থেকে?’
তিনি বললেন, ‘না, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে।’
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন খুশি হতেন, তখন তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে যেত, মনে হতো যেন তা একফালি চাঁদ এবং এতে আমরা তাঁর এ (খুশি হওয়ার) কথা বুঝতে পারতাম।
এরপর যখন আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে বসলাম, তখন আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার তওবা কবুল হওয়ার দরুণ আমি আমার সব মাল আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের রাস্তায় সাদাকা করে দিচ্ছি।’
তিনি বললেন, ‘তুমি কিছু মাল নিজের জন্য রাখ, তোমার জন্য তা উত্তম হবে।’
আমি বললাম, ‘যাই হোক! আমি আমার খায়বারের যুদ্ধে (প্রাপ্ত) অংশ রেখে দিচ্ছি।’
আর আমি এ কথাও বললাম যে, ‘হে আল্লাহর রাসুল! নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা আমাকে সত্যবাদিতার কারণে (এই বিপদ থেকে) উদ্ধার করলেন। আর এটাও আমার তওবার দাবি যে, যতদিন আমি বেঁচে থাকবো, সর্বদা সত্য কথাই বলবো।’
সুতরাং আল্লাহর কসম! যখন থেকে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সত্য কথা বলার প্রতিজ্ঞা করলাম, তখন থেকে আজকের দিন পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা কোনো মুসলিমকে সত্য কথা বলার প্রতিদান স্বরূপ এর চেয়ে উৎকৃষ্ট কোনো পুরস্কার দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই।
আল্লাহর কসম! আমি যেদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এ কথা বলেছি, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি মিথ্যা কথা বলার ইচ্ছা করিনি। আর আশা করি যে, বাকী জীবনেও আল্লাহ তাআলা আমাকে এ থেকে নিরাপদ রাখবেন।’
কাব বললেন : ‘আল্লাহ তাআলা (আমাদের ব্যাপারে আয়াত) অবতীর্ণ করেছেন-
لَقَدْ تَابَ اللهُ عَلَى النَّبِيِّ وَالْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ الَّذِينَ اتَّبَعُوهُ فِي سَاعَةِ الْعُسْرَةِ مِنْ بَعْدِ مَا كَادَ يَزِيغُ قُلُوبُ فَرِيقٍ مِنْهُمْ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ إِنَّه بِهِمْ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ – وَعَلَى الثَّلَاثَةِ الَّذِينَ خُلِّفُوا حَتّٰى إِذَا ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ الْأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنْفُسُهُمْ وَظَنُّوا أَنْ لَا مَلْجَأَ مِنَ اللهِ إِلَّا إِلَيْهِ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ لِيَتُوبُوا إِنَّ اللهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ – يٰۤاَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ
‘আল্লাহ ক্ষমা করলেন নবিকে এবং মুহাজির ও আনসারদেরকে যারা সংকট মুহূর্তে নবির অনুগামী হয়েছিল, এমন কি যখন তাদের মধ্যকার এক দলের অন্তর বাঁকা হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তারপর আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করলেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাদের প্রতি বড় স্নেহশীল, পরম করুণাময়।
আর ঐ তিন ব্যক্তিকেও ক্ষমা করলেন, যাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্থগিত রাখা হয়েছিল; পরিশেষে পৃথিবী প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের প্রতি সংকীর্ণ হয়ে উঠেছিল এবং তাদের জীবন তাদের জন্য দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল আর তারা উপলব্ধি করেছিল যে, আল্লাহ ছাড়া আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচার অন্য কোনো আশ্রয়স্থল নেই।
পরে তিনি তাদের প্রতি অনুগ্রহপরায়ণ হলেন, যাতে তারা তওবা করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ হচ্ছেন তওবা গ্রহণকারী, পরম করুণাময় (সুরা তওবা : ১১৭-১১৯)।’ (বুখারি, মুসলিম)
চিন্তা করুন- আকাবা ও বদর জেহাদের সাথী সামান্য অলসতা, দুনিয়াপ্রীতি দ্বীনী ভাইদের হতে কতটা দূরে রেখেছিল!? আর সুযোগে কুফরের পথে আহ্বান করা হয়েছিল কিন্তু তিনি এটাকে অপমান মনে করেন।
হতাশ না হয়ে আল্লাহর নিকট তওবা করে দ্বীনি ভাইদের মাঝে আজীবনের মত ফিরে এসেছেন। আল্লাহ স্বয়ং তার ক্ষমার সুসংবাদ দেন, আজও যাদের যেকোন কারনে দ্বীনী সঙ্গীদের সাথে দূরত্ব বাড়ছে, হয় পরিশুদ্ধ তওবা করুন ইনশাআল্লাহ আল্লাহ সবকিছু ঠিক করে দিবে আর নাহয় আপনার মৃত্যু যদি হয় মুনাফেকদের সাথে, শিরক, কুফরের সাহায্যরত হয়ে। তাহলে আল্লাহর কাছে কি নিয়ে দাড়াবেন!? আল্লাহ তাআলা মুমিনদের জীবন ও সম্পদ কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়। আর সে কথাও ঘোষণা করেছেন এভাবে-
اِنَّ اللّٰهَ اشۡتَرٰی مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اَنۡفُسَهُمۡ وَ اَمۡوَالَهُمۡ بِاَنَّ لَهُمُ الۡجَنَّۃَ ؕ یُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ فَیَقۡتُلُوۡنَ وَ یُقۡتَلُوۡنَ ۟ وَعۡدًا عَلَیۡهِ حَقًّا فِی التَّوۡرٰىۃِ وَ الۡاِنۡجِیۡلِ وَ الۡقُرۡاٰنِ ؕ وَ مَنۡ اَوۡفٰی بِعَهۡدِهٖ مِنَ اللّٰهِ فَاسۡتَبۡشِرُوۡا بِبَیۡعِکُمُ الَّذِیۡ بَایَعۡتُمۡ بِهٖ ؕ وَ ذٰلِکَ هُوَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ
‘আল্লাহ ক্রয় করে নিয়েছেন মুসলমানদের থেকে তাদের জান ও মাল এই মূল্যে যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাহেঃ অতঃপর মারে ও মরে। তওরাত, ইঞ্জিল ও কোরআনে তিনি এ সত্য প্রতিশ্রুতিতে অবিচল। আর আল্লাহর চেয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কে অধিক? সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেন-দেনের উপর, যা তোমরা করছ তাঁর সাথে। আর এ হল মহান সাফল্য।’
সুরা তওবা : আয়াত ১১১
আল্লাহ তাআলা এসব মুমিনদের গুণগুলোও তুলে ধরেছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাদের সুসংবাদ দিতে এভাবে সম্ভোধন করেছেন-
اَلتَّآئِبُوۡنَ الۡعٰبِدُوۡنَ الۡحٰمِدُوۡنَ السَّآئِحُوۡنَ الرّٰکِعُوۡنَ السّٰجِدُوۡنَ الۡاٰمِرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ النَّاهُوۡنَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ وَ الۡحٰفِظُوۡنَ لِحُدُوۡدِ اللّٰهِ ؕ وَ بَشِّرِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ
‘তারা তওবাকারী, এবাদতকারী, শোকরগোযার, (দুনিয়ার সাথে) সম্পর্কচ্ছেদকারী, রুকু ও সিজদা আদায়কারী, সৎকাজের আদেশ দানকারী ও মন্দ কাজ থেকে নিবৃতকারী এবং আল্লাহর দেওয়া সীমাসমূহের হেফাযতকারী। বস্তুতঃ সুসংবাদ দাও ঈমানদারদেরকে।
সুরা তওবা : আয়াত ১১২
আল্লাহ তাআলা ঈমানদার বান্দাদের নির্দেশ দিচ্ছেন তাকে ভয় করার জন্য এবং দুনিয়াতে সত্যবাদীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য। আল্লাহ বলেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ کُوۡنُوۡا مَعَ الصّٰدِقِیۡنَ
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।’
সুরা তওবা : আয়াত ১১৯
আল্লাহ তাআলা বলেন-
لَقَدۡ جَآءَکُمۡ رَسُوۡلٌ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ عَزِیۡزٌ عَلَیۡهِ مَا عَنِتُّمۡ حَرِیۡصٌ عَلَیۡکُمۡ بِالۡمُؤۡمِنِیۡنَ رَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ – فَاِنۡ تَوَلَّوۡا فَقُلۡ حَسۡبِیَ اللّٰهُ ۫٭ۖ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ؕ عَلَیۡهِ تَوَکَّلۡتُ وَ هُوَ رَبُّ الۡعَرۡشِ الۡعَظِیۡمِ
‘তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসুল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়। এরপর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে আপনি বলুন, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট; তিনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই। আমি তারই উপর নির্ভর করি এবং তিনি মহাআরশের প্রভু।’
সুরা তওবা : আয়াত ১২৮-১২৯