আলেমগণ শয়তানের ফাদ ও ষড়যন্ত্র নিয়ে বিভিন্ন অভিমত পোষন করেন। শয়তান চায় মানুষ শিরক, কুফরসহ যিনা, দুনিয়ায় সমৃদ্ধির মায়ায় দ্বীনের পথ হতে বিরত থাকুক! কিন্তু মুমিনদের যখন এসব পন্থায় বিরত রাখতে সক্ষম হয় না তখন সে চেষ্টা করে – তাদের নফল আমলে উৎসাহী করতে যেন ফরজ আমল ও দ্বীনের দাওয়াত, জেহাদ হতে বিরত রাখতে পারে!!
আনাস রাদিয়াল্লাহু ’আনহু বলেন যে, তিন ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীদের বাসায় এলেন। তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। অতঃপর যখন তাঁদেরকে এর সংবাদ দেওয়া হল তখন তাঁরা যেন তা অল্প মনে করলেন এবং বললেন, ’আমাদের সঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তুলনা কোথায়? তাঁর তো আগের ও পরের সমস্ত গোনাহ মোচন করে দেওয়া হয়েছে। (সেহেতু আমাদের তাঁর চেয়ে বেশী ইবাদত করা প্রয়োজন)।’ সুতরাং তাঁদের মধ্যে একজন বললেন, ’আমি সারা জীবন রাতভর সালাত পড়ব।’
দ্বিতীয়জন বললেন, ’আমি সারা জীবন রোযা রাখব, কখনো রোযা ছাড়ব না।’ তৃতীয়জন বললেন, ’আমি নারী থেকে দূরে থাকব, জীবনভর বিয়েই করব না।’ অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের নিকট এলেন এবং বললেন, ’’তোমরা এই এই কথা বলেছ? শোনো! আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের চেয়ে বেশী আল্লাহকে ভয় করি, তার ভয় অন্তরে তোমাদের চেয়ে বেশী রাখি। কিন্তু আমি (নফল) রোযা রাখি এবং রোযা ছেড়েও দিই, নামায পড়ি এবং নিদ্রাও যাই। আর নারীদের বিয়েও করি। সুতরাং যে আমার সুন্নত হতে মুখ ফিরিয়ে নিবে, সে আমার দলভুক্ত নয়।’’
[সহীহুল বুখারী ৫০৬৩, মুসলিম ১৪০১, নাসায়ী ৩২১৭, আহমাদ ১৩১২২, ১৩০১৬, ১৩৬৩১
শয়তান বুঝতো সাহাবীদের দিয়ে কুফর, শিরক, যিনার পথে অনুপ্রাণিত করতে পারবে না। তাদের (ওয়াসওয়াসা দ্বারা) ব্যক্তিগত নেক আমলে উৎসাহী করছিল যেন তারা দ্বীনের ব্যক্তি পর্যায়ের আমলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, দাওয়াত ও জেহাদের মত বড় কাজ হতে বিরত রাখা সহজ হয়।
অপর হাদীসে রয়েছে –
আবুল ‘আব্বাস (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ‘আবদুল্লাহ্ ইবনু ‘আমর (রাযি.) হতে শুনেছি, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেনঃ আমাকে কি জানানো হয়নি যে, তুমি রাত ভর ‘ইবাদাতে জেগে থাক আর দিনভর সিয়াম পালন কর? আমি বললাম, হ্যাঁ, তা আমি করে থাকি।
তিনি ইরশাদ করলেনঃ একথা নিশ্চিত যে, তুমি এমন করতে থাকলে তোমার দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে যাবে এবং তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়বে। তোমার দেহের অধিকার রয়েছে, তোমার পরিবার পরিজনেরও অধিকার রয়েছে। কাজেই তুমি সিয়াম পালন করবে এবং বাদও দেবে। রাতে জেগে ‘ইবাদাত করবে এবং ঘুমাবেও। (১১৩১) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১০৮১, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১০৮৬)
কোন ব্যক্তি একটানা রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়ে, সিয়াম আদায় করে ফলে তার শরীর দুর্বল হয়ে যাবে, চক্ষু নষ্ট হবে। স্ত্রী, পারিবারিক অধিকার ক্ষু্ন্ন হবে, দাম্পত্য কলহ হতে পারে, রিযিকের পেরেশানিতে পড়তে পারে, কর্মকক্ষেত্রে অকার্যকর হবে দুর্বলতা ও অনীহার কারনে। ফলে দাওয়াত ও জেহাদের বড় ফজিলত হতে বিরত রাখা যাবে এভাবে দ্বীন ইসলামের প্রসারে ভূমিকা রাখা হতে বিরত রাখা যাবে!
আল্লাহ বলেন-
তারপর আমরা তাদের পিছনে অনুগামী করেছিলাম আমাদের রাসূলগণকে এবং অনুগামী করেছিলাম মার্ইয়াম-তনয় ঈসাকে, আর তাকে আমরা দিয়েছিলাম ইঞ্জীল এবং তার অনুসারীদের দিয়েছিলাম করুণা ও দয়া। আর সন্ন্যাসবাদী—এটা তো তারা নিজেরাই আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য প্রবর্তন করেছিল। আমি (রব) তাদেরকে এটার বিধান দেইনি; অথচ এটাও ওরা যথাযথভাবে পালন করেনি। অতঃপর তাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছিল, তাদেরকে আমরা দিয়েছিলাম তাদের পুরস্কার। আর তাদের অধিকাংশই ছিল ফাসিক। (সুরা হাদীদ-২৭)
এখানে ঈসা আলাইহিস সালাম-এর প্রতি ঈমান আনয়নকারী হাওয়ারীগণের বিশেষ গুণ বৰ্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, যারা ঈসা আলাইহিস সালাম অথবা ইঞ্জিলের অনুসরণ করেছে, আমি তাদের অন্তরে স্নেহ ও দয়া সৃষ্টি করে দিয়েছি। তারা একে অপরের প্রতি দয়া ও করুণাশীল কিংবা সমগ্র মানবমণ্ডলীর প্রতি তারা অনুগ্রহশীল। এখানে ঈসা আলাইহিস সালাম-এর সাহাবী তথা হাওয়ারিগণের দুটি বিশেষ গুণ উল্লেখ করা হয়েছে; তা হচ্ছে, দয়া ও করুণা। এরপর তাদের আরেকটি অভ্যাস বর্ণিত হয়েছে যা তারা আবিস্কার করে নিয়েছিল। আর যা আল্লাহ তাদের উপর আবশ্যিক করে দেন নি। আর সেটা হচ্ছে, সন্যাসবাদ বা দ্বীনের ইবাদতকে শুধুমাত্র কিছু ব্যক্তি আমলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা।
অনেক দ্বীনি ভাইয়ের মধ্যে এই জিনিসটা বিদ্যমান – নফল আমলে খুবই আগ্রহী, ফরজ দাওয়াত ও অন্যায়ের প্রতিবাদের ক্ষেত্রে নিরব। নিজগৃহে তাহাজ্জুদ ঠিকই পড়ছে কিন্তু গৃহে তাগুতের অনুসরন চলছে সেই বিষয়ে নিরব।
অথচ আল্লাহ বলেন-
আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যে এ মর্মে রাসুল পাঠিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো ও ‘তাগুত’ বর্জন করো। অতঃপর তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক মানুষকে আল্লাহ সৎ পথে পরিচালিত করেন এবং কিছুসংখ্যকের জন্য বিপথগামিতা অবধারিত হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো, মিথ্যা আরোপকারীদের কী পরিণতি হয়েছিল। (সুরা : নাহল, আয়াত : ৩৬)
আসলে তাহাজ্জুদ পড়ার চেয়ে তাগুতের বিরোধিতা জরুরি ও কঠিন। তাহাজ্জুদ, নফল আমলে অনেকে প্রশংসা করবে আর তাগুতের বিরোধীতায় নির্যাতন, জুলুমের সম্ভাবণা প্রবল থাকে।
আবার কেউ আছে এমন – বাবা-মায়ের সেবা ও মেহমানদারী করা উত্তম তাই তাদের প্রিয় বাজার করা ও রান্না করতে গিয়ে অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দেয়! অথচ তাদের এসব স্বজনেরা দ্বীন ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
আল্লাহ বলেন-
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা স্বীয় পিতা ও ভাইদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা কুফরকে ঈমানের উপর প্রাধান্য দেয়। তোমাদের মধ্য হতে যারা তাদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করবে, তারাই হবে যালেম’’। (সূরা তাওবা: ২৩)
অথচ এই সময়ে বহু বড় দ্বীনী আমল করতে পারতো! সাহাবীরা কি তাদের সন্তান, পিতামাতাকে ভালোবাসতেন না, রসুল (সা:) ও সাহাবীরা খুব অল্পতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। তাদের মেহমানগনও অল্পতে তৃপ্ত হতেন ও দ্বীনের প্রয়োজনে সময় ব্যয় করাই উত্তম মনে করতেন! অনেকে খেলাকে হালাল ভেবে – ঘন্টার পর ঘন্টা এসব নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। এমনকি খেলোয়াড়েদের দ্বীনদারিতা, ইসলামী চিন্তাবোধ নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনায় সময় অতিবাহিত করে। অথচ তাদের নিকট রসুলের (সা:) চারিত্রিক আদর্শ রয়েছে কুরআন, সুন্নাহ যার মাধ্যমে দ্বীনে আহ্বান সহজ ও উত্তম!
অনেককে দেখি মাসয়ালাগত দ্বন্দ্ব ও আলেমের সমালোচনা, শেষ জমানা নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটায় অথচ আকীদা পরিশুদ্ধ করতে অনাগ্রহী। আপনি মরলে পরকালের পথে যাত্রা শুরু – আকীদা পরিশুদ্ধ না করে শেষ জমানা নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা মিডিয়া, ইউটিউব সত্য-মিথ্যার তথ্য নিয়ে কি লাভ হবে!?
সুস্পষ্ট বুঝেন – বিশ্বের সকল মাসয়ালা সকল আলেম জানবে না। রসুল (সা:) যেভাবে সকল হাদীস জানতেন ও আমল করতেন, সাহাবীদের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না! কিন্তু সকলের আকীদা ও আদর্শ একই ছিল! তেমনি বর্তমানে কোন ব্যক্তিই সাহাবীদের মত হবে না, কিন্তু আকীদা ও আদর্শ একই হতে হবে! তাই আমাদের আহ্বান হবে – নিজ চরিত্র বা পছন্দনীয় আলেমের দিকে নয় বরং রসুলের (সা:) জীবনীর দিকে। যার চরিত্র ছিল কুরআনের অনুরুপ। তাই কোন ব্যক্তির আকীদা বিশুদ্ধ হলে তার কিছু ভুলকে অজুহাত করে সত্য দ্বীন গ্রহন হতে বিরত থাকা হল – শয়তান ও ফেরাউনদের নীতির অনুসরণ করা।
ফেরাউনকে যখন দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া হয় – তখন ঈমান আনার পরিবর্তে উল্টো যুক্তি দিল-
ফির‘আউন বলল, ‘আমরা কি তোমাকে শৈশবে আমাদের মাঝে লালন পালন করিনি? আর তুমি তোমার জীবনের অনেক বছর আমাদের মধ্যে অবস্থান করেছ’। (সুরা শুআর-১৮)
এছাড়া মুসা (আ:) দ্বারা ভুলবশত হত্যাকান্ডের সমালোচনা করে যা ইসলাম গ্রহনের সাথে সম্পর্কিত ছিল না! যদি মেনেও নিই মুসা (আ:) ভুল করেছিল কিন্তু তার দ্বীনের দাওয়াত ছিল বিশ্বজাহানের রবের হতে যা নির্ভুল। অপরদিকে সবচেয়ে বড় গোনাহের অন্যতম হল – রসুলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। উহুদে খালিদ বিন ওয়ালিদের (রা:) বিরোধিতায় সাহাবীরা শহীদ হন ও স্বয়ং রসুল (সা:) রক্তাক্ত হোন। যখন তিনি দ্বীন গ্রহন করলেন, রসুল (সা:) তাকে স্বাগত জানিয়েছেন, তিনি হয়ে উঠেছিলেন আল্লাহর তরবারী। মুসলিমরা ওনার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল, পরস্পর মিলে করেছিলেন রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের বিজয়!!
এই যুগে শয়তানের ধোকা হতে মুমিনদের সর্তক হতে হবে-
সবাই যখন হজে যাচ্ছিল তখন হুসাইন (রা:) পবিত্র ভূমি ও হজের ভূমি হতে দূরে কুফায় যাচ্ছিলেন- উম্মাহর বুকে চেপে বসা রাজতন্ত্র ও জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার করতে ফলশ্রুতিতে তিনি শহীদ হন। হাজারও হাজী সাহাবী, তাবেয়ীর নাম ও অবদান অনেকে জানে না। কিন্তু আজও জান্নাতি যুবকদের সর্দার হুসাইন (রা:)। মুমিনদের উদাহরণ ও আদর্শ।