একদিকে বাড়ছে শপিংমল, মার্কেট অন্যদিকে বাড়ছে বস্ত্রহীন মানুষ। বিক্রি হচ্ছে দামী দামী জামা কাপড়। যাকাতের শাড়ীর জন্য কাউকে আঘাত পেতে হচ্ছে। একদিকে বাড়ছে রেস্টুরেন্টগুলো (চাইনিজ, দেশী, বিদেশী), বিক্রি হচ্ছে দামী দামী খাবার। অন্যদিকে বাড়ছে ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদ, ডাস্টবিনের পরিত্যক্ত খাদ্যে কুকুর ও মানুষের যুদ্ধ। কারো নতুন ব্যবসা চালু হচ্ছে চাঁদার টাকায়, কারো ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে চাঁদা না দেওয়ায়।
একদিকে চলছে ভেজাল বিরোধী অভিযান অন্যদিকে বাড়ছে সিগারেট, বিদেশী মদের আমদানী, হচ্ছে লাইসেন্সকৃত মদের দোকান। কারণ হালাল হারাম (বৈধ, অবৈধ) বিধান এখন আর কুরআন হতে মানা হয় না, হচ্ছে মানবরচিত সংবিধান হতে। বাড়ছে মসজিদ, মাদ্রাসা আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বহুগুণে বাড়ছে পাপ, শিরক, বিদআত, কমছে মুসল্লি ও দ্বীনদার মুমিনের অভাব।
বাড়ছে ওয়াজ, বাড়ছে টাকার পরিমাণ। একটু জনপ্রিয় হলেও বছরখানেকের মধ্যে লাখ লাখ টাকা আয় করে যাচ্ছে। কেউ ওয়াজে পুলিশের নিরাপত্তায় বহুবিবাহের ফজিলতের মধুর ওয়াজ করছে, কারো সদ্যবিবাহ হয়েছে অথচ বাসর না হয়ে দিন কাটছে কারাগারে। কত যুবক মিথ্যা মামলায় স্বজন ছেড়ে প্রবাসে দিন কাটছে, অশ্রুসিক্ত প্রার্থনা দেশে ফিরবে মায়ের বুকে।
প্রিয় শায়েখ! কতদিন বউ, শিশু সন্তানের মুখ দেখেননি। অথচ সাহাবীদের বেশিরভাগ বহুবিবাহ করেছে মদীনার জীবনে যখন মুসলিমদের নিরাপদ স্হান হয়েছে ও ইসলাম পালন করা যেত। বহু সাহাবী শহীদ হতেন তাদের স্ত্রী, বোন, মায়ের দায়িত্ব নিতেন অন্য সাহাবীরা বিবাহ করে। আর মক্কার জীবন ছিল জুলুম, নির্যাতনে ভরা। সুমাইয়া (রা:) এর যৌনাঙ্গে বর্শা নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়েছিল, কতটা অসহায় ছিল মুসলিম।
স্বয়ং রসুলের (সা:) দুই কন্যাকে তালাক দিয়েছিল পিতা রসুলের (সা:) ইসলাম মানার কারনে। আর তারা যেন বলতে চায়- এটা মদীনার সময়ের ইসলাম মানার মতো উপযোগী রাষ্ট্র তাই বড় বড় ফরজ (সত্য দ্বীন প্রচার) ছেড়ে নফল নিয়ে বাড়াবাড়ি। কারো বাড়ি, জমি দখল হচ্ছে আর ভূমিদস্যুরা গড়ছে বড় বড় দালানকোঠা শপিংমল। নিরীহ ধর্ষিত মেয়েটা লজ্জায় কারো সাথে মিশতে পারে না সমাজ তাকে ঘৃনা করছে, আর স্বেচ্ছায় ইজ্জ্বত বিলিয়ে অনেক তারকা তরুনদের কাছে অতি প্রিয়।
আশেকে রসুল দাবিদারদের অভাব নেই তবু বাড়ছে ইসলাম ও রসুলের অবমাননাকারী। বংশ নিয়ে গর্ব করা লোকের অভাব নেই, পরিবারকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত অথচ রসুলের (সা:) আহলে বায়াতের ফজিলত কেউ বয়ান করে না, তাদের উপর কি নির্যাতন হয়েছে, চলছে তা নিয়ে আলোচনা হয় না।
নবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক রাখ, কেননা আল্লাহই তোমাদের রিজিক দেন এবং তোমাদের লালন-পালন করেন। আর আল্লাহর মহব্বতের ভিত্তিতে আমার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক রাখ এবং আমার মহব্বতের কারণে আমার আহলে বাইতের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক রাখ।’ (তিরমিজি ৩৭৮৯)
যাইদ ইবনু আরকাম (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে আমি এমন জিনিস রেখে গেলাম যা তোমরা শক্তরূপে ধারণ (অনুসরণ) করলে আমার পরে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তার একটি অন্যটির তুলনায় বেশি মর্যাদাপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণঃ আল্লাহ তা’আলার কিতাব যা আকাশ হতে মাটি পর্যন্ত দীর্ঘ এক রশি এবং আমার পরিবার অর্থাৎ আমার আহলে বাইত। এ দুটি কখনও আলাদা হবে না কাওসার নামক ঝর্ণায় আমার সঙ্গে একত্রিত না হওয়া পর্যন্ত। অতএব তোমরা লক্ষ্য কর আমার দু’জনের সঙ্গে তোমরা কিভাবে আচরণ কর। (তিরমিজি, ৩৭৮৮)
আহ!! বহুজনই দাবি করে ইসলাম পালন করছে তবু ইসলামই আজ গুরাবা (অপরিচিত)। আমরা যেন সবাই আগুনের (জাহান্নামের) নিকট দাড়িয়ে অন্যকে সতর্ক করছি। অন্যের সমালোচনা ও আফসোস করছি নিজেকে সংশোধন করতে ভুলে গেছি।
দ্বীনের রজ্জুকে শক্তভাবে আকড়ে ধরার দরুন নিজের পরিবার-পরিজন, সমাজ-রাষ্ট্রসহ সবার কাছে অপরিচিত, সমালোচিত হয় যারা, ইসলামের পরিভাষায় তাদেরকেই বলা হয় গুরাবা। গুরাবা হচ্ছে অপরিচিত, দ্বীন পালনের কারণে যারা অপরিচিত হয়ে গেছে। যার অর্থ গরিব, মিসকিন, অসহায়। গুরাবা হচ্ছে আমাদের সমাজেরই মানুষ, সমাজে থেকেও যেন তারা আজ সমাজের কেউ নয়।
সমাজের সর্বত্র যেখানে ফিতনার ছড়াছড়ি। দ্বীন বিমুখতা, গুনাহর সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া, আল্লাহর বিধানকে অবজ্ঞা করা, নফসের অনুসরণ করা, ক্ষমতার বাহাদুরি করা লোকের অভাব নেই সেখানে একদল লোক আছে যারা কুরআন-সুন্নাহকে আকড়ে ধরেছে, দুনিয়ার জীবনকে আখিরাতের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে, আল্লাহ ও তার রাসূলকে নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবেসেছে। সমাজের এত এত মানুষের ভিড়ে এরাই মূলত গুরাবা।
এরাই হল সেই সব গুরাবা যাদের কথা হাদীসে এসেছে-
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ইসলাম অপরিচিত অবস্থায় পদযাত্রা শুরু করেছে আবার অপরিচিত অবস্থায় ফিরে যাবে। সুসংবাদ অপরিচিত ব্যক্তিদের জন্য। সুসংবাদ গুরাবাদের জন্য। সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) জিজ্ঞাস করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ্!(ﷺ) গুরাবা কারা?
রাসূল(ﷺ) বললেন, গুরাবা হলেন ঐ সমস্ত লোক, মানুষেরা গোমরাহ হলে যারা তাদের সংশোধন করবে।
(মুসনাদে আহমাদ ইবনু হাম্বল:৩৭৭৫,৮৮১২)।
অনেক আলেমরা বলেন গুরাবা হল-
যারা রসূলের (সা) সুন্নাহকে জীবিত করে এবং তা মানুষের কাছে শিক্ষা দেয়।
প্রবাসী এক ভাইয়ের কথা মনে পড়ে!! হালাল রিযিকের জন্য বহু কষ্ট করেছিল, লাখ টাকা আয়ও করেছিল কিন্তু জমায় নি। কারণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দ্বীন ও জনকল্যানে ব্যয় করবে। কিন্তু মাত্র ২-১ বছর প্রবাসে থেকে অনেকে দামী বাড়ি, ব্যবসার মালিক হয়েছিল আর নিত্যদিন তিনি উপহাসের শিকার হয়েছেন।
পৈতৃিক দোচালা ঘর আজও তেমনি পড়ে আছে। চিন্তা করুন, ১৫, ২০ বা ৩০, ৪০ লাখ টাকায় বাড়ি করবে সাময়িক দুনিয়ার জন্য। তার পরিচিত অনেকের সারাজীবনের সম্পদ পুড়ে গেছে, ইনশাআল্লাহ তার সম্পদ যা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করেছে জান্নাতে অজীবন জমা রয়েছে।
অথচ আমাদের পাশেই কেউ ১০ টাকার জন্য না খেয়ে আছে, কেউ আবার চিৎকিসার অভাবে মুমূর্ষু। কেয়ামত দিবসে আল্লাহর নিকট কিভাবে দাঁড়াবো, তবু আমাদের জীবন অনেক বিলাসী। হা, এখনও কিছু দানশীল, তাকওয়াবান মানুষ আছে। দুঃখ, কষ্ট, ব্যবসা হারানো তাদের জীবনে পরীক্ষা।
আল্লাহ বলেন,
আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবোই: মাঝে মধ্যে তোমাদেরকে বিপদের আতঙ্ক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে, সম্পদ, জীবন, পণ্য-ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। আর যারা কষ্টের মধ্যেও ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, তাদেরকে সুখবর দাও।
আল-বাক্বারাহ ১৫৫
আইয়ুবও (আ) সব হারিয়েছিলেন সবর ও দোয়া করে তারচেয়ে বেশি পেয়েছিলেন। রমাদ্বান মাসে যাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে দুঃখ না করে সময়টা ইতেকাফে লাগান। ইনশাআল্লাহ দুনিয়া, আখেরাতে লাভবান হবেন। দীর্ঘসময় ব্যস্ততায় হয়তো দূরে থেকেছেন, আল্লাহ সুযোগ করে দিয়েছেন তার কাছে আসার।