অদৃশ্যের জ্ঞান ও কেয়ামত

অদৃশ্যের জ্ঞান শুধুমাত্র আল্লাহর নিকট এটা আমরা অনেকে মানি কিন্তু অনেকে অদৃশ্য জ্ঞান কি আজও ঠিকমত বুঝি না। ফলে বিভ্রান্ত হচ্ছি। আল্লাহ বলেন,

আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহরই। তাঁরই কাছে সব কিছু প্রত্যাবর্তিত হবে। সুতরাং তোমরা তাঁর ইবাদত করো এবং তাঁর ওপর নির্ভর করো। তোমরা যা করো, সে সম্পর্কে তোমার প্রতিপালক অনবহিত নন।

সুরা : হুদ, আয়াত : ১২৩

তাফসির : এটি সুরা হুদের সর্বশেষ আয়াত। আগের আয়াতে অবিশ্বাসীদের সাময়িক অবকাশ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। আলোচ্য আয়াতে মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, সবার ভালো করে জানা থাকা উচিত যে বিশ্বজগতের সব কিছুই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে। সবকিছু সম্পর্কে তিনি অবহিত।

দৃশ্য-অদৃশ্য ও প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবই তাঁর জানা। কাজেই মানুষের উচিত একমাত্র তাঁরই উপাসনা করা। দুঃসময়ে তাঁর ওপরই নির্ভর করা।

ইলমে গায়েব বা অদৃশ্য জ্ঞান কী?

ইলম শব্দের অর্থ জ্ঞান। আর যে বস্তু মানুষের জ্ঞান ও দৃষ্টির অন্তরালে, তাকেই সাধারণত মানুষ ‘গায়েব’ বলে অভিহিত করে। কিন্তু ইসলামের পরিভাষায়, যেসব বিষয় এখন পর্যন্ত অস্তিত্ব লাভ করেনি কিংবা অস্তিত্ব লাভ করলেও কোনো সৃষ্ট জীবকে আল্লাহ তাআলা সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবগত হতে দেননি, তাকেই ইলমে গায়েব বলা হয়। মূলত গায়েবী ইলম বলতে বুঝায় যা মাখলুকের কাছে অদৃশ্য কিন্তু আল্লাহর জ্ঞানে তা রয়েছে। এমন নয় তা আল্লাহর কাছে অদৃশ্য বরং তার কাছে দৃশ্যমান।

আর রসুল (সা:) ততটুকু জানেন যতটুকু আল্লাহ জানিয়েছেন। আল্লাহ বলেন-

“আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই, তিনি জীবিত, সবকিছুর ধারক। তাঁকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না এবং নিদ্রাও নয়। আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে, সবই তাঁর। কে আছ এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? দৃষ্টির সামনে কিংবা পিছনে যা কিছু রয়েছে সে সবই তিনি জানেন। তাঁর জ্ঞানসীমা থেকে তারা কোন কিছুকেই পরিবেষ্টিত করতে পারে না, কিন্তু যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন। তাঁর সিংহাসন সমস্ত আসমান ও যমীনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। আর সেগুলোকে ধারণ করা তাঁর পক্ষে কঠিন নয়। তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বাপেক্ষা মহান।”

সূরা বাকারা: ২৫৫

যেমন – রসুল (সা:) জিব্রাইলকে (আ:) আসলরূপে দেখেছিলেন, সম্পূর্ণ আল্লাহর ইচ্ছায়। এছাড়া ইসরা, মেরাজে তিনি নবী, রসুলগণ ও জান্নাত-জাহান্নামের অনেককিছু দেখেছেন যা অন্যদের কাছে আল্লাহ অদৃশ্য রেখেছেন। এটা বিশ্বাস করা আমাদের ঈমানের অংশ।

তা সম্পূর্ণ আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে।

অনেকে এটাকে দলিল করে বলেন- পীর, বুজুর্গদের দ্বারা অনেক কিছুই সম্ভব বলে প্রচার করে। রসুলের (সা:) ইসরা ও মেরাজ প্রতিদিন ঘটেনি বরং আল্লাহর ইচ্ছেয় একবারই হয়েছে যার দলিল আছে। অথচ ওরা যেসব কারামতির দাবি করে তার সাপেক্ষে কি এরূপ দলিল আছে? অনেকে বুজুর্গদের কবরে গিয়ে দোয়া চান! অথচ সাহাবীরা কখনও এইরূপ আমল করেনি।

বদর যুদ্ধ শেষে কাফিরদের লাশগুলোকে দাফন করা হয়। লাশ দাফন শেষে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাফিরদের নামধরে ডাকতে থাকেন। নামধরে ডেকে তিনি সূরা আরাফের ৪৪ নাম্বার আয়াত তেলাওয়াত করেন-

“তোমাদের সাথে রব যে ওয়াদা করেছেন, তা তোমরা বাস্তবে পেয়েছো?”

এটা দেখে উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বেশ অবাক হলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি মৃতদেরকে ডেকে কথা বলছেন?” অর্থাৎ, তারা তো মৃত। আপনি তাদের সাথে কিভাবে কথা বলছেন? উমরের (রা:) প্রশ্নের জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন (ভাবানুবাদ),
“তোমরা যেমন আমাকে শুনছো, তারাও ঠিক আমাকে শুনছে; কিন্তু তারা জবাব দিতে পারছে না।” [সহীহ বুখারী: ১৩৭০]

আরেকটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “বান্দাকে যখন তার কবরে রাখা হয় এবং তার সাথীরা এতোটুকু দূরে যায়, সে তখনো তাদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পায়।” [সহীহ বুখারী: ১৩৭৪]

এগুলোর ব্যাখা করলে বড় হবে তাই সরল ব্যাখা করি। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন:

“নিশ্চয় তুমি মৃতকে শুনাতে পারবে না, আর তুমি বধিরকে আহ্বান শুনাতে পারবে না, যখন তারা পিঠ ঘুরিয়ে চলে যায়।”

সূরা আন-নামল- ২৭: ৮০

“আর জীবিতরা ও মৃতরা এক নয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা শুনাতে পারেন, কিন্তু যে ব্যক্তি কবরে আছে তাকে তুমি শুনাতে পারবে না।”

সূরা আল-ফাতির- ৩৫: ২২

কুরআন আর হাদীস হতে এইটুকু জানা যায়- মানুষ চাইলেও মুর্দাকে শোনাতে পারবে না। আল্লাহ যদি চান তাহলে যতটুকু চান ততটুকু শোনবে। যেমন- বান্দাকে যখন কবরে রাখা হয় তখন আল্লাহ তাকে শোনার তৌফিক দেয় এজন্য শোনে।

এবার আসি কেয়ামত প্রসঙ্গে

আল্লাহ তাআলা বলেন-

‘কেয়ামতের জ্ঞান কেবল আল্লাহর কাছেই আছে; তাঁর অজ্ঞাতসারে (জানার বাইরে) কোনো ফল আবরণ মুক্ত হয় না, কোন নারী গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসব করে না। যেদিন আল্লাহ ওদেরকে ডেকে বলবেন, ‘আমার অংশীদাররা কোথায়?’ তখন ওরা বলবে, ‘আমরা আপনার কাছে নিবেদন করেছি যে, (এ ব্যাপারে) আমাদের মধ্যে কেউ সাক্ষী নয়।’

সুরা হামিম আস-সাজদা : আয়াত ৪৭

কেয়ামতের জ্ঞান শুধুমাত্র আল্লাহর কাছে রয়েছে। রসুলও (সা:) জানতেন না কখন, কোন সময় কেয়ামত হবে। আবার আমরা জানি, কোন মুসলিম জীবিত থাকা অবস্থায় কেয়ামত হবে না। অথচ হাদীসে আছে –কিয়ামত পর্যন্ত আমার উম্মাতের একদল হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে বাতিলের বিরুদ্ধে কিতাল করতে থাকবে এবং অবশেষে ঈসা (আলাইহিস সালাম) অবতরণ করবেন। মুসলমানদের আমীর বলবেনঃ আসুন, সালাতে আমাদের ইমামত করুন। তিনি উত্তর দিবেনঃ না, আপনাদেরই একজন অন্যদের জন্য ইমাম নিযুক্ত হবেন। এ হল আল্লাহর প্রদত্ত এ উম্মাতের সম্মান। (সহীহ মুসলিম, হাদিস নম্বরঃ ২৯২)

তাহলে এগুলো কি পরস্পর বিরোধী?

আসলে কেয়ামতের কয়টি শ্রেনী আছে যা বুঝতে হবে। আলেমদের মতে- কোন ব্যক্তি বা জাতির মৃত্যুর সাথে সাথে তার হিসাব-নিকাশ (কেয়ামতের ধাপ) শুরু (কবরের জান্নাতের প্রশান্তি ও আযাব) হয়। আবার মুসলিম জাতির কেয়ামত হবে একসাথে যা ঈসা (আ:) এর পরবর্তীতে সকল দ্বীনদার মুসলিম একসাথে মারা যাবে তখন। এখানে কেয়ামত পর্যন্ত একটি দল হক্বের পথে অটল থাকবে বলতে মুসলিম জাতির কেয়ামত পর্যন্ত বুঝানো হয়েছে।

আর আসমান, জমিন পৃথিবী সমস্ত মাখলুক কোনদিন ধ্বংস হবে তা হলো বিশ্ব কেয়ামত যা শুধু আল্লাহ জানেন।
এছাড়া পুনরুত্থান, বিচার দিবস রয়েছে। তাই কেয়ামতের আলামত নিয়ে আলোচনা করি তার মানে এই নয় আমরা নিজ হতে গায়েব বা ভবিষ্যৎ বর্ননা করছি। বরং আল্লাহ তার রসুলকে (সা:) যা জানিয়েছেন তার গবেষণাভিত্তিক আলোচনা করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *